আন্তর্জাতিক ডেস্ক: আজ ১৩ ই আগস্ট ল্যাটিন আমেরিকার বুকে লাল ঝান্ডা উড়িয়ে, আজীবন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধা বীর বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর শুভ জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং বিপ্লবী লাল সালাম।
নিজের লোডেড ৪৫ পিস্তলটি প্রেমিকা মারিতার হাতে তুলে দিলেন দুঃসাহসী কাস্ত্রো৷ মারিতার হাতে খুন হওয়ার জন্য, কিন্তু তারপর….
প্রথম দর্শনেই হৃদকম্পন অনুভব করেছিলেন মারিতা লরেঞ্জ। ছিপছিপে চেহারার সেনার পোশাক পরা তরুণ, গালে দাড়ি, তার ওপর যদি সেই মানুষটি হয় একটি দেশের জনপ্রিয় নেতা, তার সম্মোহন ক্ষমতা হয়তো একটু আলাদাই হবে! প্রথম দর্শনেই বোধহয় সুদর্শন, সুপুরুষ ছিপছিপে চেহারার যুবকের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন বছর উনিশের মারিতা৷ শত্রুর শ্যেন দৃষ্টি, আর হত্যার ছককে বানচাল করে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকাটা বিস্ময়কর ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর নিজের কাছেও৷ তিনি স্বয়ং একবার বলেছিলেন, ‘’আমি সত্যিই খুশি যে, ৮০ বছরে পৌঁছে গেছি। আমি এটা আশা করিনি। বিশ্বের শক্তিধর প্রতিবেশী থাকার পরও এটা আশা করিনি। যারা প্রতিদিন আমাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করছে।’’ ফিদেল কাস্ত্রো, কিউবার প্রয়াত বিপ্লবী ও রাজনৈতিক নেতা। অসংখ্য বার তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে৷ আশ্চর্যজনকভাবে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তিনি বেঁচে গিয়েছেন বহাল তবিয়তে৷ শোনা যায় অন্তত ৬৩৮’র বেশি বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে শত্রুরা৷ কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে গুপ্তঘাতকদের মিশন৷ এমন কি তাঁর প্রেমিকা যিনি মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলেন কাস্ত্রোকে, যিনি ছিলেন ছন্দবেশী ঘাতক, তিনিও ভালবাসার অমোঘ টানে ভুলে গিয়েছেন ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার কথা৷ মারিতা লরেঞ্জ কিউবায় এসেছিলেন ছদ্মবেশী আততায়ী হয়ে। খুনের টার্গেট ছিলেন তাঁরই ভালবাসার মানুষ ফিদেল কাস্ত্রো৷
কিন্তু যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে কি অত সহজে ভোলা যায়!
পারা যায় কী প্রেমিকের রক্তে নিজের ভালবাসাকে মলিন, বিবর্ণ করতে?
কাস্ত্রো ছিলেন মারিতার জীবনের প্রথম প্রেমিক। যে প্রেমের আগুন, ভালবাসা, আবেগ চলেছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস৷ প্রেমিকা স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রো সম্পর্কে স্মৃতিচারনায় তিনি বলেছেন অন্য কারো প্রতি তাঁর এমন মন্ত্রমুগ্ধ ভালোবাসা ছিলনা, অন্য কেউই পারেননি মারিতার হৃদয়ে প্রেমানুভূতির এমন আশ্চর্য রকমের আবেশের হিল্লোত তুলতে। কাস্ত্রো ছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম পুরুষ, তাঁর প্রথম প্রেমিক, প্রথম ভাললাগা, প্রথম প্রেমে পড়া৷
মানুষের মনোজগৎ হচ্ছে সত্যিই রহস্যময়, নারী-পুরুষের পারস্পারিক সম্পর্ক সে যে বড় রহস্যময়!
ফিদেল কাস্ত্রোর প্রেমিকা মারিতা লরেঞ্জে যে জীবনে অন্য কারও প্রেমে পড়েননি এমনটা মোটেও নয়, তাঁর জীবনে ছিল একাধিক প্রেম৷
কিন্তু আমরা সেই মারিতার কথা বলবো যিনি জীবনের ২৫টি বসন্ত কাটিয়েছিলেন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা এফবিআই ও সিআইএ’র তথ্যদাতা ও সফল গুপ্তচর হিসেবে৷ তিনি সুন্দরী, তিনি লাস্যময়ী, অত্যন্ত মেধাবী, গুপ্তহত্যায় অতীব পটু, প্রায় সব মিশনই পালন করেছেন সফলভাবে৷ কখনও তাঁর হৃদয় প্রশ্ন করেনি, কখনও কেঁপে ওঠেনি তাঁর হাত, হৃদয়৷ সেই তিনিই ব্যর্থ হয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রোকে চিরদিনের মত পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে৷
১৯৬০সালে মারিতা কিউবাতে ফিরেছিলেন উদ্দেশ্য ছিল সেই এক আর অভিন্ন৷ চিরদিনের মত কাস্ত্রোকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া৷ মারিয়ার হাতে ছিল বটুলিজম নামের দুটো ট্যাবলেট, যা যেকোনও পানীয়তে মিশিয়ে দিয়ে ফিদেল কাস্ত্রোকে খাওয়াতে পারলেই সফল হবে সিআইএ’র মিশন৷ চিরদিনের মত ঘুমে ঢলে পড়বে কাস্ত্রো৷ সুযোগের অপেক্ষায় মারিতা৷
অবশেষে এল বহু প্রতীক্ষিত সেই সুযোগ৷ হোটেলের নাম হাভানা হিলটন৷ স্যুইট নম্বর-২৪০৮, এই কক্ষে অতীতেও তাঁরা কাটিয়েছেন কত সোনালী রাত৷ ভালবাসায়, আবেগে, আবেশের সেইসব রাতকে ভুলে আজকের মিশনটা যে আলাদা৷
চিরদিনের মত পৃথিবী থেকে সরাতে হবে প্রেমিক ফিদেল কাস্ত্রোকে৷ হোটেলের বাইরে সিআইএ’র বাঘা-বাঘা গুপ্তচরেরা৷ উত্তেজনার পারদে ফুটছেন৷ কখন আসবে সেই প্রতীক্ষিত খবর, চিরদিনের মত খতম কাস্ত্রো!
কিন্তু ভালবাসা যদি মাঝখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়, তবে কী বা আর করার থাকতে পারে মারিতার পক্ষে? অনেক সময় পরে কাস্ত্রো এলেন, স্যুইট নম্বর-২৪০৮৷
এদিকে মারিতা হারিয়ে ফেলেছেন তাঁর আসল উদ্দেশ্য, ভুলেই গিয়েছেন কেন তিনি কাস্ত্রোর সঙ্গে হোটেলের স্যুইটে৷ জীবনের প্রথম প্রেমকে দেখেই নষ্টালজিক মারিতা বোধহয় বুঝেছিলেন এই হত্যা তাঁর পক্ষে অসম্ভব!
মারিতাকে দেখেই কাস্ত্রো বলেছিলেন তুমি কি আমার বিরোধীদের সাথে এখনো মিয়ামিতে যোগাযোগ রাখছো? তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল তুমি কি সিআইএ’র হয়ে কাজ করছো? উত্তরে মারিতা বললেন আমি শুধু নিজের হয়ে কাজ করি৷
বুদ্ধিমান কাস্ত্রোর পরের প্রশ্নটি ছিল আরও মোক্ষম, তুমি কি আমায় হত্যা করতে ফিরে এসেছো?
উত্তরে মারিতা বলেছিলেন হ্যাঁ৷
নিজের লোডেড ৪৫পিস্তলটি মারিতার হাতে তুলে দিলেন দুঃসাহসী কাস্ত্রো৷ চেম্বার চেক করে পিস্তলটি প্রেমিকের দিকে তাক করলেন৷ শুধু একটা গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে কাস্ত্রোর ফুসফুস, হৃদপিন্ড, শিরা-ধমনী৷ রক্তের ফুলকিতে সুনিশ্চিত হবে আমেরিকার চিরশত্রু কাস্ত্রোর শেষ নিঃশ্বাস৷
শান্ত কাস্ত্রো মারিতার দিকে চেয়ে বললেন তুমি আমায় মারতে পারবে না, কেউ আমায় হত্যা করতে পারবে না৷ এই বলে কাস্ত্রো মারিতেকে জড়িয়ে ধরলেন, টেনে নিলেন নিজের বুকের মধ্যে৷ ব্যর্থ হলো আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থার মিশন৷ এই একটি বার মারিতা লরেঞ্জ তার মিশনে সম্পূর্ন ফেল করলেন৷ ঘুমন্ত কাস্ত্রোকে স্যুইটে রেখে তিনি ফিরলেন আবার মিয়ামিতে৷
আসলে মারিতা পারেননি তাঁর প্রথম প্রেমকে হত্যা করতে, পারেননি তিনি ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করতে৷ তিনি হেরেছিলেন প্রেমের কাছে, আবেগের কাছে, ভালবাসার কাছে, ভাললাগার আবেশের কাছে৷ অথচ সেই তিনিই পরে আরও অনেক মিশন সফল ভাবে শেষ করেছেন, দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিয়েছেন, মিশন শেষে পরিতৃপ্তির হাসি হেসেছেন৷ তিনি মারিতা লরেঞ্জ দ্য রিয়েল লাইফ স্পাই হু লাভড ফিদেল কাস্ত্রো৷
দ.ক/রোর.মিডিয়া