
স্বাক্ষাৎকার
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নির্বাহী কমিটির সহ স্হানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক সাবেক এমপি শাম্মী আক্তার সাথে কালনেত্র প্রতিনিধির দীর্ঘ আলাপচারিতায়- রাজনৈতিক আদর্শ বনাম প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, “রাজনীতি কোনো পেশা নয়, ব্রত; দেশপ্রেম ও জনকল্যাণের মূল্যবোধ সে ব্রতের মূল লক্ষ্য।”
আরও ব্যক্ত করেন, রাজনৈতিক আদর্শের কথা শুনলে অনেকে এখন হাসেন। তাদের মতে, রাজনীতি থেকে আদর্শ হারিয়ে গেছে। তাই আদর্শ নামের মূল্যবোধটির অস্তিত্ব এখন আর রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায় আমি সাহিত্যিক রোমেনা আফাজের ‘হারানো মানিক’ উপন্যাসটি পড়েছিলাম। এখন কেন যেন রাজনৈতিক আদর্শকে ‘হারানো মানিক’ বলেই মনে হয়।
বলেন, কথায় আছে, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’। যতই দিন গড়াচ্ছে, রাজনীতির আঙিনা থেকে নীতি-আদর্শ কর্পূরের মতো উধাও হয়ে যাচ্ছে। নীতি-আদর্শের জায়গা দখল করছে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসিকতা।
বিগত বছরগুলোতে আমরা একটি দলের নেতাকর্মীদের দমে দমে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন’ বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা শুনতাম। কিন্তু তাদের কাজকর্মে তার কোনো প্রতিফলন ছিল না। বরং বিস্ময়কর হলো, ওই সময়ে যারা দুর্নীতি-লুটপাটে লিপ্ত ছিল, তাদের মুখেই শোনা যেত ‘মুজিববাদ’ কায়েমের স্লোগান।
মুজিবকন্যা হাসিনা সরকারে ছিলেন সর্বমোট প্রায় একুশ বছর। প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) তার সরকারেরর মন্ত্রী, এমপি এবং দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বেশুমার অভিযোগ উঠেছিল। সারা দেশে সন্ত্রাসের গডফাদারদের নেতৃত্বে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ পরিচয়দানকারীরা লিপ্ত হয়েছিল সর্বাত্মক দুর্নীতিতে। একইভাবে সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানে যবনিকাপাত হওয়া তাদের ১৫ বছরের শাসনামল ছিল আরও ভয়াবহ। দুঃশাসনের পাশাপাশি চলেছে ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচার। অবাক কাণ্ড হলো, বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা টিভি টকশোয় যারা ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের’ কথা গলা চড়িয়ে বলতেন, তারাই ছিলেন তাবৎ অপকর্মের হোতা। তারা সরকারি বড় বড় প্রকল্পের অর্থ লোপাট করেন, ব্যাংক ফোকলা করে অর্থনীতিকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়েছেন, অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ অবৈধ পথেই বিদেশে রপ্তানি করেছেন। আর তা দিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ নানা দেশে করেছেন বাড়ি-গাড়ি। চট্টগ্রামের এক নেতা যিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রী ছিলেন, ব্রিটেন, আমেরিকা, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে কয়েকশ বাড়ির মালিক। শুধু ওই একজনই নন, হাসিনা মন্ত্রিসভার সদস্য কিংবা আওয়ামী লীগের এমপি বা নেতা, প্রায় সবারই দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ সম্পদের খবর প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যম বেরিয়েছে।
বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে সবই আছে শুধু আদর্শ ছাড়া। অথচ রাজনীতির মূলমন্ত্রই নীতি ও আদর্শ। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতি কোনো পেশা নয়, ব্রত। আর দেশপ্রেম ও জনকল্যাণের মতো মূল্যবোধ সে ব্রতের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে চিন্তাভাবনা করেন, যা একটি দলের মেনিফেস্টোতে উদ্ধৃত থাকে, সেটাই হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট দলের আদর্শ। এই আদর্শ বাস্তবায়নে একেক দল একেকভাবে চিন্তা করে, যাকে বলা হয় কর্মসূচি। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত সে কর্মসূচি নিয়েই দলগুলো জনগণের সামনে যায়, তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু কখনো কি কেউ শুনেছে, কোনো রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় বা নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ঘুষ-দুর্নীতির প্রসার, টেন্ডারবাজি, দখল, চাঁদাবাজিকে আদর্শ ও কর্মসূচি হিসেবে উল্লেখ করেছে? এমনটি কখনো শোনা যায়নি, ভবিষ্যতেও হয়তো শোনা যাবে না। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সরকারে যাওয়ার পর মেনিফেস্টোতে বর্ণিত আদর্শ-কর্মসূচিকে একপাশে সরিয়ে রেখে নেতাকর্মীরা ওইসব অলিখিত আদর্শকেই আঁকড়ে ধরে।
গত বছর ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনাময় দলটির কতিপয় নেতাকর্মী দেশজুড়ে যেসব ঘটনার জন্ম দিয়েছে, তা কি ওই দল বা দলটির প্রতিষ্ঠাতার আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একজন সৎ ও নীতিবান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সমাদৃত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়গহস্ত। নিজে দুর্নীতি করেননি, কারও দুর্নীতিকে বরদাশতও করেননি।
আজ যারা ‘এক জিয়া লোকান্তরে, লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে’ স্লোগান দেন, তাদের কজন তার সততা ও দেশপ্রেমের আদর্শকে অন্তরে ধারণ করেন? জিয়াউর রহমান ছিলেন সমকালীন রাজনীতির এক আদর্শবাদী নেতা; সততা ছিল যার রাজনীতির প্রধান অলংকার। আজ কজন জিয়ার সৈনিক সে আদর্শকে লালন করেন? মৌখিক আদর্শবাদীর তো অভাব নেই। অভাব মৌলিক আদর্শবাদী নেতাকর্মীর। আর আদর্শবাদী কর্মী তারাই, যাদের কাজকর্মে প্রতিফলন ঘটে নেতার আদর্শের। রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার করে বিত্ত-বেসাত গড়ার অভিপ্রায়কে পরিত্যাগ করতে না পারলে নেতার ‘আদর্শের সৈনিক’ হিসেবে পরিচয় না দেওয়াই ভালো।
রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে আলোচনাকালে শাম্মি আরও বলেন, ‘আদর্শ এখন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বাটখারায় বিচার্য।’ কথাটি ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, ‘আজকাল আদর্শ পরিণত হয়েছে মুখের বুলিতে, অন্তরে এর ঠাঁই নেই। এখন বেশিরভাগ দল পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে ব্যক্তিগত লাভ-অলাভের হিসাবনিকাশের ভিত্তিতে। যে দলে গেলে বা যে আদর্শের স্লোগানে গলা মেলালে লাভবান হওয়া যাবে, সে আদর্শের কথাই শোনা যায় অনেকের মুখে।’
আদর্শ পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। জিয়ার আদর্শের রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া, শামসুল হুদা চৌধুরী, ডা. এম এ মতিন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিব আদর্শের কোরবান আলী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বাম আদর্শের কাজী জাফর আহমদ, আনোয়ার জাহিদ, সিরাজুল হোসেন খানদের মতো বিশিষ্ট রাজনীতিকরা সব নদীর সাগরে মেশার মতো এরশাদের আদর্শের মোহনায় মিশে গিয়েছিলেন। তারা সবাই গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্র হরণকারী স্বৈরশাসকের সঙ্গে হাত মেলাতে কসুর করেননি। তাদের এ আদর্শ পরিবর্তন যে শুধু প্রাপ্তিযোগের কারণেই সংঘটিত হয়েছিল, দেশবাসীর কাছে তা অস্পষ্ট থাকেনি।
সর্বশেষ তিনি বলেন, রাজনীতির কিছু মানুষের আদর্শহীনতা সাধারণ মানুষকে এ জনহিতকর কর্মটি থেকে বিমুখ করে তুলেছে।
দ.ক.সিআর.২৫