ড. তপন দেববর্মা, চুনারুঘাট
হবিগঞ্জ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের এক অনন্য জেলা, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষের জীবন একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে নানা রঙে।
এখানে বিস্তৃত হাওরের নীল জলরাশি বর্ষাকালে আকাশের সাথে মিশে যায়, যেন দিগন্তহীন সমুদ্র। মাছধরা নৌকা, জাল বোনা জেলে, আর পানিতে ভাসমান ধানের চারা — সব মিলে হাওরের জীবন এক প্রশান্তির ছবি আঁকে। কিন্তু হবিগঞ্জ কেবল হাওরের দেশ নয়। এখানে আছে গভীর বনভূমি— রেমা-কালেঙ্গা, সাতছড়ি, লাউয়াছড়ার মতো অরণ্য, যেখানে বুনো পাখির ডাক আর ঝরনার শব্দ মিলেমিশে এক প্রাকৃতিক সিম্ফনি তৈরি করে। এ বনের বুকে লুকানো আছে বন্যপ্রাণীর আশ্রয়, আবার কাঠ ও জমি দখলের লোভে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার ইতিহাসও। আর আছে চা-বাগান— ঢেউ খেলানো সবুজ চা-গাছের সারি, যা যেন কোনো চিত্রশিল্পীর তুলিতে আঁকা।
সকালবেলার কুয়াশায় চা-পাতা তোলার দৃশ্য এক অনিন্দ্য সৌন্দর্য তৈরি করে। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে আছে শ্রমিকদের কষ্ট, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা কম মজুরি আর বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস।
হবিগঞ্জের বৈচিত্র্য তাই দ্বিমুখী — কোথাও প্রশান্তি, যেখানে প্রকৃতি নিঃশব্দে শান্তি বিলায়; আবার কোথাও চিরকালীন দুঃখ, যা মানুষের চোখে অদৃশ্য অথচ অন্তরে গভীরভাবে গেঁথে আছে। এই বৈপরীত্যই হবিগঞ্জকে করে তোলে একই সাথে মোহনীয় ও মর্মস্পর্শী।
পরিপ্রেক্ষিতে আছে হবিগঞ্জের হাওরের বিস্তৃতি, যেখানে বর্ষার পানি সমগ্র ভাওরকে ঢেকে দিয়ে দিগন্ত ছুঁয়ে যায়। এখানকার জেলেদের নৌকা, তাদের প্রতিদিনের সংগ্রাম, এবং নদীতীরে বেঁচে থাকা জীবন— সব মিলিয়ে দুটি মুখ তুলে ধরে: একদিকে নিরব প্রশান্তি, অন্যদিকে মানুষের জীবনের কঠোর বাস্তবতা।
এসব নিয়ে স্বরচিত একটি কবিতা—
❝হাওরের নীল জলে ভেসে থাকে শান্ত সকালের সুর,
বনের সবুজে লুকায় জীবনের গোপন গল্প,
চা-বাগানের ঢেউয়ে দুলে ওঠে পরিশ্রমী হাতের ঘাম।
কোথাও প্রশান্তি, যেন সময় থেমে গেছে;
আবার কোথাও—চিরকালীন দুঃখ,
যেন মাটির ভেতরে গেঁথে রাখা পুরনো দীর্ঘশ্বাস।❞
_____
লেখক, ড তপন দেববর্মা, অর্থনীতিবিদ, পিএসডি, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দ.ক.সিআর.২৫