কালনেত্র ডেস্ক
শিশুর বেড়ে ওঠা শুধু উচ্চতায় নয়—ভেতরের সুস্থতাতেও। আর সেই ভিত গড়ার যাত্রা শুরু হয় প্রতিদিনের প্লেট থেকে। খাবার শুধু পেট ভরানোর বিষয় নয়, এটি আচরণ গড়ে তোলে, অভ্যাস তৈরি করে, এমনকি একটি শিশুর শরীর ও মন গঠনে চুপিচুপি বড় ভূমিকা রাখে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর মস্তিষ্কের ৯৫% গঠিত হয় প্রথম ৫ বছরে। এই সময়ের খাবার কেবল শরীর গড়ার জন্য না, শিশুদের চিন্তা, স্মৃতি আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ভিত্তিও তৈরি করে দেয়।
তাই জাঙ্কফুড, বেশি চিনি বা তেলে ভাজা খাবার থেকে সরিয়ে শিশুদেরকে স্বাস্থ্যকর খাবার উপভোগ করতে শেখান। শুধু “না” করে কিছু হয় না—খাবার নিয়ে কীভাবে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলছেন, সেটাও জরুরি। কীভাবে করবেন কাজটা? তা থাকছে এই লেখায়।
.
১. গল্পের ভাষায় খাবারের গুরুত্ব বোঝান
তথ্য যোগ করে কথা বললে শিশুরা বিরক্ত হয়। বরং গল্প বলুন, বাচ্চাদের পছন্দের কার্টুন বা সুপারহিরোদের টেনে আনুন। যেমন—“জানো, সুপার হিরোরা এত শক্তি পায় কীভাবে? ফল আর সবজি খেয়ে খেয়ে।” এভাবে কল্পনার সঙ্গে জুড়ে দিলে ওরা আগ্রহ পায়।
২. আপনার শিশুকেই বেছে নিতে দিন
“আজ তোমার প্লেটে কোন কোন রঙের সবজি থাকবে?” বা “তুমি আপেল খাবে না কলা?”—এইভাবে বিকল্প দিয়ে দিন। এতে বাচ্চারা ভাবার সুযোগ পায়, নিজেরা কী চায় তা বলতে শেখে। কখনো কখনো বাজার করতে নিয়ে যান, ওদেরকেও বাছাই করতে দিন। এটাও শেখার একটা ধাপ।
৩. একসাথে খাওয়ার সময়টাও শেখার সময় হতে পারে
সবাই মিলে একসাথে খাওয়া মানে একটা সুন্দর সময়। এসময় গল্প বলুন, ছোট্ট কুইজ করুন—“এই খাবারে কী ভিটামিন আছে বলো তো?” বা “এটা আমাদের শরীরে কী কাজ করে?”—এরকম প্রশ্ন বাচ্চারা পছন্দ করবে। চাইলে বাচ্চাকে সাথে নিয়ে নতুন স্বাস্থ্যকর কিছু রান্না করুন।
৪. আপনি যা করবেন, শিশু তাই শিখবে
বাচ্চারা দেখে শেখে। আপনি যদি নতুন সবজি ট্রাই করেন, খাবার নিয়ে নেতিবাচক কিছু না বলেন—ওরাও আপনাকে অনুসরণ করবে। আপনি বলতেই পারেন—“এটা আগে খাইনি, দেখি তো খেতে কেমন।” দেখবেন ওরাও আগ্রহী হবে।
৫. খাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করুন, খেতে বাধ্য না করে
“এইটা খাও”, “ওটা কেন খাচ্ছো না”—এভাবে না বলে, খাবারের উপকারিতা নিয়ে কথা বলুন। বাচ্চাদেরকেও প্রশ্ন করতে দিন—“এটা খেলে কী হয়?”, “এই খাবারটা কেন দরকার?”—আপনিও উত্তর দিন সহজ করে। এতে ওরা নিজে থেকেই জানতে চাইবে।
৬. খাবারকে আকর্ষণীয় করে তুলুন
প্লেটে রঙিন ফল দিয়ে হাসিমুখ বানানো, বা মজার কোনো আকার বানানো—এসব বাচ্চারা পছন্দ করে। রান্নায় ছোটখাটো কাজ করাতে পারেন—সালাদ মিক্স করা, প্লেট সাজানো, এমনকি টেবিলে খাবার দেওয়ার কাজ। এতে বাচ্চাদের মনে হবে, “এটা আমি বানিয়েছি”, তাতে খাওয়ার আগ্রহও বাড়বে।
৭. কোনটা নিয়মিত, কোনটা মাঝে মাঝে—এইভাবে শেখান
“ভাল” বা “খারাপ” খাবার বলার চেয়ে “প্রতিদিন খাওয়ার খাবার” আর “মাঝে মাঝে খাওয়ার খাবার” বলা অনেক বাস্তবধর্মী। গল্প, ছবি বা চার্টের মাধ্যমে দেখান—কোন খাবার শরীর গড়তে সাহায্য করে আর কোনগুলি শুধু স্বাদের জন্য। এতে ওরা অপরাধবোধ ছাড়াই খাবার নিয়ে সচেতন হবে।
৮. খাওয়ার সময় শুধু খাওয়া
টিভি, ট্যাব, মোবাইল বা অন্য কিছু যতটা সম্ভব দূরে রাখুন খাওয়ার সময়। আপনার শিশুকে বলুন, “এই সময়টা শুধু খাওয়ার জন্য।” এতে ওরা ধীর গতিতে মনোযোগ দিয়ে খাবে, যা হজমে সাহায্য করবে। আর শরীর ঠিক ঠিক বুঝতে পারে কখন পেট ভরে গেছে, তাই বেশি খাওয়ার ঝুঁকিও কমে। এটি ছোটবেলায় শেখাতে পারলে সারাজীবন বাচ্চাদের উপকারে আসবে।
৯. প্রশংসা করুন, কিন্তু খাবার দিয়ে পুরস্কার নয়
নতুন কিছু ট্রাই করলে বা স্বাস্থ্যকর কিছু খেলে প্রশংসা করুন—“তুমি আজ দারুণ করেছ!”, “তোমার প্লেটটা কত সুন্দর লাগছে!”—এভাবে বলুন। পুরস্কার হিসাবে গল্প শোনা, স্টিকার দেওয়া বা শিশুর পছন্দের খেলা খেলতে পারেন, কিন্তু খাবারকে (বিশেষ করে অতি মিষ্টি খাবার বা চকলেট) পুরস্কার হিসাবে দেবেন না।
১০. হাতে-কলমে শেখান
বাজারে গিয়ে প্যাকেট দেখিয়ে আপনার সন্তানকে জিজ্ঞেস করুন—“এই জুসে কতটুকু চিনি আছে বলো তো?” ছোট ছোট ভিডিও, ছবির বই, বা গল্প দিয়ে দেখান—প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন এসব কেন দরকার, কোন খাবারে কী থাকে। তাহলে খাবারের লেবেল পড়ার অভ্যাসও তৈরি হয়ে যাবে।
শিশুর সঙ্গে খাবার নিয়ে কথা বলার সময়টা হোক স্বাভাবিক, খোলামেলা আর মজার। অংশ নিতে দিন, প্রশ্ন করতে দিন, গল্প শুনতে দিন। আপনি যতটা সহজভাবে বিষয়গুলি বোঝাবেন, বাচ্চাদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা ততটাই সহজ হবে। আর একবার সেটা তৈরি হলে, অনেকদিন পর্যন্ত টিকে যাবে।
দ.ক.সিআর.২৫