শ্রেষ্ট ইসলাম: বাগান এক অদ্ভুত নিবাস। প্রায় জনমানবহীন আবাসস্থল।
প্রকৃতির মধ্যেই চা-শ্রমিকরা বসবাস করেন। আমি দীপু, শহর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসেছি চা-বাগানে। বাগানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতির কোমল বাতাস আমাদের বরণ করে নিল। যেন মনে হলো, নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছি। আমরা বাগানের ভেতরের দিকে প্রবেশ করলাম। গাছে গাছে শোনা যাচ্ছে পাখির কিচিরমিচির, জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে পোকাদের ডাক। আমরা আনন্দের সঙ্গে ঘোরাফেরা করছি। এক পর্যায়ে আমরা বাগান হাটের দিকে রওনা হলাম।
আসতে আসতে শুনেছি আজ নাকি চা-শ্রমিকরা সপ্তাহিক হাট করবেন। শুনে খানিকটা বিচিত্র মনে হলো। তবে কেমন হবে বাগানের হাট —দেখার আগ্রহ হলো। পাহাড় বেয়ে হাটে পৌঁছালাম। কী বিস্ময়কর! এরকম মনোমুগ্ধকর স্থান হয়তোবা এর আগে কখনো দেখা হয়নি আমাদের। ছোট ছোট টিলাগুলোর মধ্যে বসেছে দোকান। চা-শ্রমিকরা দলে দলে এসে সদাই করছেন। তাদের মুখের হাসি বলে দেয় তারা আজ আনন্দিত। আমরা একটি টং দোকানে বসলাম। আমাদের দেখেই বিজু দেব নামে একটি ছেলে এগিয়ে এলো। হাসিমুখে বলল, “দাদারা কি বাগান দেখতে আসছেন?”
আমরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম। বলল, “আসুন ভিতরে আসুন, এটা আমাদের দোকান। আপনারা আমাদের অতিথি।”
তার কর্মচারী শংকরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “দাদাদের জন্য চা নিয়ে আয়, গরম গরম পরোটা নিয়ে আয়।” আমাদের দেখতে আরো ১৫-২০ জন মানুষ জড়ো হল। তাদের আন্তরিকতা দেখে আমি মুগ্ধ। আমি বিস্মিত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। তারা কতটা সহজ-সরল—এক নিমেষে আপন করে নিল আমাদের। আমি লক্ষ্য করলাম বিজু দেব নামক ছেলেটি স্মার্টফোন বের করে বলছে, “দাদার ফেসবুক আইডিটা যেন কী?”
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, “বাগানে কি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়?”
সে হেঁসে মাথা নাড়ে।
বাগানকেও ভেদ করেছে নেটওয়ার্ক।
আমি ফেসবুক আইডি দিয়ে খাবারের টাকা পরিশোধ করতে গেলাম। বিজু পয়সা রাখতে নারাজ। বলল, “আপনারা আমাদের অতিথি। আপনাদের কাছ থেকে পয়সা রাখলে আমরা কষ্ট পাবো।”
তাদের সহজ-সরল কথাবার্তা মনকে আরও কোমল করে দেয়।
আমরা ফের বাগানের উদ্দেশ্যে চললাম।
কিছু পথ যেতেই দেখা মিলল একদল তরুণী, মাথায় ঝুড়ি বেঁধে ফিরছে। হয়তো কাজ থেকে এসেছে।
তাদের দেখে আমি বাক্যহীন হয়ে পড়ি।
এত সংগ্রামের বিনিময়ে কি মানুষ বাঁচে?
কিছু পথ যেতেই দেখা মিলল এক চা-শ্রমিক ও তার ছেলে। সে বাবাকে বলছে, “আজকে হাট থেকে মাছ নিয়ে আসব, অনেকদিন হলো মাছ খাই না।”
বাবা মলিন হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন, “তোর যে মাছটি পছন্দ হবে, সেটাই নিয়ে আসব।”
ছেলে আনন্দে নিজস্ব ভাষায় গান গেয়ে গেয়ে হাটের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।
হয়তো এভাবেই তাদের হাসির মধ্যে লুকিয়ে থাকে শত শত বেদনা ও সংগ্রামের পথ।
দ.ক.সিআর.২৫