
পারভেজ হাসান, লাখাই : লাখাইয়ের বুক চিরে বয়ে চলা ধলেশ্বরী নদীর (তৃতীয় খণ্ড) জলমহাল খাইঞ্জা বিল। মাছের অফুরন্ত উৎস এই বিল যেন এখন শান্তির বদলে রক্তের বন্যা বইয়ে চলেছে। গত কয়েক মাস ধরে এই বিলের দখল নিয়ে একের পর এক সংঘর্ষে আহত হচ্ছেন শতাধিক মানুষ, ঘটছে নৌকা পোড়ানোর মতো ঘটনা। এই পরিস্থিতি প্রশ্ন তুলছে একটি জলমহালের ইজারা কি মানুষের জীবনের চেয়েও দামি?
সংঘর্ষের মূল কারণ: জলমহালের ইজারা ও আধিপত্য
খাইঞ্জা বিল ধলেশ্বরীর ৩ জলমহালের ইজারা এবং এর দখলকে কেন্দ্র করেই মূলত এই সংঘাতের সৃষ্টি। জলমহাল বা বিল সাধারণত মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলোকে ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু ইজারার নেপথ্যে থাকা রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ যখন মুখ্য হয়ে ওঠে, তখনই শুরু হয় সত্যিকারের দ্বন্দ্ব।
জলাশয়ে মাছ ধরা ও বিক্রির মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন হয়, তা স্থানীয় প্রভাবশালী মহলকে এই বিলের দখল নিতে প্ররোচিত করে। বিলটিকে ঘিরে যেন মাছের বদলে টাকা ওড়ে, সেই লোভই রক্ত ঝরাচ্ছে।
রাজনৈতিক আধিপত্য: এই ইজারা স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের একটি হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে। যে পক্ষ বিল দখল করতে পারে, তারা এলাকায় নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
রাজনৈতিক মেরুকরণ: দল নয়, যেখানে স্বার্থ এক
আওয়ামী লীগ-বিএনপি এক হয়ে বিল দখল করছে কেন?
সাধারণত বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি বিপরীত মেরুর দল। কিন্তু খাইঞ্জা বিলের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নেতা দলীয় মতাদর্শকে গৌণ করে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীর স্বার্থে একজোট হয়েছেন।
স্বার্থের জোট:বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এই সংঘর্ষে কখনও কখনও স্থানীয় বিএনপির একাধিক গ্রুপের মধ্যে আবার কখনও ক্ষমতাসীন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং বিএনপি নেতার জোটবদ্ধ দখলের চেষ্টা দেখা যায়। এর থেকে পরিষ্কার হয়, বিলের দখল নিতে গিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র তকমা ভুলে গিয়ে কেবল ‘অর্থনৈতিক স্বার্থের জোট’ তৈরি করেছেন।
প্রশ্ন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে
বারবার সংঘর্ষ হচ্ছে, মানুষ আহত হচ্ছে, তবু কেন এই সংঘাত থামানো যাচ্ছে না?
সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে যে ইজারা প্রদান এবং বিলের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রশাসনের দুর্বলতা রয়েছে। রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পরও যদি থানায় অভিযোগ না হয় বা পরিস্থিতি সাময়িকভাবে শান্ত হওয়ার পর আবার সংঘাত শুরু হয়, তবে বুঝতে হবে দীর্ঘমেয়াদী কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
লাখাই কি স্বাধীন নয়?:স্থানীয় প্রভাবশালীরা যদি নিজেদের স্বার্থে বারবার আইন লঙ্ঘন করে এবং প্রশাসন তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তবে সাধারণ মানুষ অসহায় বোধ করবেই। তাদের কাছে তখন লাখাইয়ের পরিবেশ স্বাধীন ও নিরাপদ মনে হবে না।
এখন প্রয়োজন স্থায়ী সমাধান
রক্তের বন্যা থামাতে হলে বিলের দখল নিয়ে এই মারামারি, দ্বন্দ্ব এবং সহিংসতা এখনই থামাতে হবে।
ইজারা নীতি পুনর্বিবেচনা:ধলেশ্বরীর ৩ জলমহাল ইজারা না দিলে কী হয়? উত্তর হলো, এর ফলে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের একটি অংশ জীবিকা হারাতে পারে। তবে বৃহত্তর শান্তি ও জনজীবনের নিরাপত্তার জন্য এই জলমহালের ইজারা নীতি পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। প্রয়োজনে সরকার জলমহালগুলো মুক্ত (উনমুক্ত)ঘোষণা করে স্থানীয় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের তত্ত্বাবধানে মাছ ধরার সুযোগ করে দিতে পারে।
আইনের কঠোর প্রয়োগ: অবিলম্বে সংঘর্ষে জড়িত প্রভাবশালী ও উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে দল-মত নির্বিশেষে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্থানীয় মৎস্যজীবীদের অধিকার নিশ্চিত করা:প্রকৃত মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলো যেন সুষ্ঠুভাবে ইজারা পায় এবং মধ্যস্বত্বভোগী বা ক্ষমতাধরদের দৌরাত্ম্য না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এই সংঘাতের শেষ হোক। আর কোনো মায়ের কোল যেন খাইঞ্জা বিলের রক্তের বন্যায় খালি না হয়। লাখাইয়ে শান্তি ফিরুক, বিল তার প্রকৃত সৌন্দর্য আর মাছের প্রাচুর্য নিয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত হোক।
দ.ক.সিআর.২৫