
নাজমুল ইসলাম হৃদয় : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই সরগরম হয়ে উঠছে হবিগঞ্জ জেলার রাজনৈতিক অঙ্গন। জেলা ও উপজেলা সদর, হাট-বাজার, চা-বাগান এলাকা—সবখানেই প্রার্থীদের পদচারণা, গণসংযোগ, পোস্টার-ব্যানার আর পথসভার জোয়ার। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও চলছে প্রচারণামূলক জনসভা ও কর্মী সমাবেশ।
জেলা জুড়ে এবার নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে বিএনপির রাজনীতি। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে পিছিয়ে থাকলেও এবার ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হবিগঞ্জের চার আসনেই জয় পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে দলটি। নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাস—“এবারের নির্বাচনে জনতার সাড়া BNP–এর পক্ষে”, যদিও চার আসনেই রয়েছে তীব্র বহুমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
এদিকে এখনো জেলার কোনো আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রার্থী ঘোষণা না করায় নির্বাচন ঘিরে কৌতূহলও বাড়ছে সাধারণ ভোটারদের মাঝে।
হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ–বাহুবল) একটি পৌরসভা ও ২০ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে বিএনপির চূড়ান্ত প্রার্থী হয়েছেন ড. রেজা কিবরিয়া। তার নাম ঘোষণার পর থেকেই এলাকাজুড়ে বেড়ে গেছে তৎপরতা।
সাবেক এমপি শেখ সুজাত মিয়া একসময় সক্রিয় থাকলেও এখন কিছুটা নীরব। অপরদিকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মুখলিছুর রহমান প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গণসংযোগ করছেন।
এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন— জামায়াতের মো. শাহজাহান আলী, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা আবু হানিফা আহমদ হোসেন, খেলাফত মজলিসের মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মুফতি সিরাজুল ইসলাম মিরপুরী ও গণঅধিকার পরিষদের আবুল হোসেন জীবন।
এই আসনে ভোটারদের মতামতে নবীগঞ্জের ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান বলেন, “এখানে সমীকরণ এবার পাল্টাতে পারে। নতুন মুখ রেজা কিবরিয়া তরুণদের মধ্যে ভালো সাড়া পাচ্ছেন।”
বাহুবলের কলেজছাত্রী বৃথী আক্তার বলেন, “যে উন্নয়ন করবে, নিরাপত্তা দেবে—আমরা তাকেই চাই। দল নয়, এবার যোগ্যতা দেখবো।”
হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং–আজমিরীগঞ্জ) এ আসন দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এবার বিএনপির প্রচারণা নজর কাড়ছে। দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন। অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী আহমদ আলী মুকিব রণেভঙ্গ দিয়েছেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে পারেন খেলাফত মজলিসের আমির বড় হুজুর মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ। পাশাপাশি প্রচারণায় আছেন জামায়াতের অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান আজমী, গণঅধিকার পরিষদের অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা নোমান সাদিক ও ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা হাদীসুর রহমান রুহানী।
এ আসনে ভোটারদের মতামতে বানিয়াচঙ্গের কয়েক জন অটোরিকশা চালক বলেন, “আমরা পরিবর্তন চাই। এবার দেখছি সবাই প্রচারণা বাড়িয়েছে।”
আজমিরীগঞ্জের বয়স্ক ভোটার রহিমা বেগমের ভাষ্য—“উপকার যিনি করেন, তাকেই ভোট দিই। জনগণের পাশে কে দাঁড়ায়—তা আমরা দেখি।”
হবিগঞ্জ-৩ (সদর–লাখাই–শায়েস্তাগঞ্জ) এ আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী সাবেক পৌরমেয়র জি কে গউছ। উপজেলা-সদরজুড়ে তার প্রচারণা সবচেয়ে দৃশ্যমান।
অন্য প্রার্থীরা হলেন— জামায়াতের কাজী মহসিন আহমদ, ইসলামী আন্দোলনের মহিব উদ্দিন আহমেদ সোহেল, গণঅধিকার পরিষদের অ্যাডভোকেট নোমান , খেলাফত মজলিসের অ্যাডভোকেট ছারওয়ার রহমান চৌধুরী ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা আলামিন ভুঁইয়া।
এ আসনে ভোটারদের মতামতে সদরের বিভিন্ন স্কুলশিক্ষকরা বলেন, “এ আসনে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। সবাই নিজেদের মতো কাজ করছে।”
শায়েস্তাগঞ্জের গৃহিণী লাকি আক্তার বলেন, “আমরা চাই শান্তি ও উন্নয়ন। প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবে কাজ দেখুক জনগণ।”
হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর–চুনারুঘাট) দুটি পৌরসভা ও ২৩ ইউনিয়নের এ আসনটি চা-শ্রমিক ভোটারদের কারণে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। এবার বিএনপির মনোনীত প্রার্থী শিল্পপতি সৈয়দ মো. ফয়সল মাঠে নেমে প্রচারণা জোরদার করেছেন।
এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন— জামায়াতের সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা আনোয়ার হোসেন রাজী ও ইসলামী আন্দোলনের কামাল উদ্দিন।
এ আসনে ভোটারদের মতামতে মাধবপুরের চা-শ্রমিকরা বলেন, “আমাদের জীবন-মান উন্নয়ন সবচেয়ে বড় বিষয়। যে খেয়াল রাখবে, আমরা তাকেই ভোট দেব।”
চুনারুঘাটের কয়েক যুবক বলেন, “এবার দেখা যাচ্ছে বিএনপিও বেশ সক্রিয়। লড়াই হবে টাইট।”
সব মিলিয়ে জেলার চারটি আসনেই বহুমাত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, পাল্টাপাল্টি প্রস্তুতি, নতুন নতুন প্রার্থীর আগমন এবং জনগণের ভিন্নমুখী প্রত্যাশা—সবই মিলে এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবিগঞ্জে তৈরি করেছে বিশেষ উত্তাপ।
বিএনপি চার আসনেই জয় দেখতে চাইলেও শেষ সিদ্ধান্ত দেবে ভোটাররা।
জনমত বলছে—হবিগঞ্জে এবারের নির্বাচন হবে অতি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের।
দ.ক.সিআর.২৫