
হাফিজুর রহমান, রাজারহাট উপজেলা প্রতিনিধি
কুড়িগ্রামের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন হলো চাকিরপশার বিল। সবুজে মোড়া বিস্তৃত মাঠ আর নীল জলে ভরা এই জলাশয়টি মৌসুম বদলের সাথে সাথে তার রূপও পাল্টে যায়। বর্ষায় বিলজুড়ে জলরাশির বিস্তার, আর শীতের আগমনে উন্মুক্ত মাঠে পরিণত হওয়া—প্রকৃতির এমন রূপসী খেলা প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করছে স্থানীয় ও বাইরের হাজারো দর্শনার্থীকে।
সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় প্রশাসন এই বিলের অফুরন্ত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে এটিকে একটি টেকসই ইকো-ট্যুরিজম বা প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে।
চাকিরপশার বিলের চারপাশে গড়ে উঠেছে নানান গাছপালা, মাছ ধরার ঘাট ও পাখির অভয়ারণ্য। এর স্বচ্ছ জলরাশি এবং শান্ত পরিবেশ স্থানীয়দের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত। তবে এটি এখন শুধু মাছ ধরার কেন্দ্র নয়, এটি পরিণত হয়েছে প্রকৃতিপ্রেমীদের এক নতুন গন্তব্যে।
অতিথি পাখির আগমন: শীতকালে এই বিল হয়ে ওঠে হাজারো অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর। ভোরবেলা কুয়াশা মাখা জলের উপর যখন সূর্যের আলো পড়ে, তখন বিলটি যেন রূপ নেয় এক অপূর্ব ছবির মতো।
•স্থানীয় অর্থনীতির ছোঁয়া: স্থানীয় তরুণ-তমতোরা বিলের পাশে তৈরি করেছে নৌকা ভ্রমণ ও গ্রামীণ খাবারের ছোট ছোট স্টল। এর ফলে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তেমনি পর্যটকরাও পাচ্ছেন গ্রামীণ জীবনের স্বাদ এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার উপভোগের সুযোগ।
প্রশাসনের দূরদর্শী পরিকল্পনা: পরিবেশবান্ধব পর্যটন কাঠামো
এই বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে স্থানীয় প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল ইমরান জানান, “আমরা চাই না এই প্রাকৃতিক সম্পদ অযথা বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক। বরং, স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে একটি পরিবেশবান্ধব ও সুপরিকল্পিত পর্যটন কাঠামো তৈরি করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
প্রশাসনের পরিকল্পনায় যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে:
•পর্যটন অবকাঠামো: বিলের চারপাশে হাঁটার পথ ও কাঠের সেতু নির্মাণ করে দর্শনার্থীদের জন্য ভ্রমণের সুবিধা বাড়ানো।
•নিরাপদ ভ্রমণ: পর্যটকদের জন্য নিরাপদ নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা চালু করা।
•স্থানীয় অর্থনীতি: স্থানীয় কৃষিপণ্য ও হস্তশিল্প বিক্রির জন্য ছোট মার্কেট জোন তৈরি করা, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে।
•সংরক্ষণ: অতিথি পাখিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা নির্ধারণ এবং বিলের পানি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কঠোর পরিবেশবান্ধব নিয়মনীতি প্রণয়ন করা।
স্থানীয়দের প্রত্যাশা ও কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত
চাকিরপশার গ্রামের বাসিন্দা মো: আনোয়ার হোসেন বলেন, “আগে বিল মানেই ছিল শুধু মাছ ধরা। এখন মানুষ আসে ঘুরতে, ছবি তুলতে, নৌকা চালাতে। যদি সরকার ঠিকভাবে উন্নয়ন করে, তাহলে আমাদের জীবনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।” স্থানীয় যুবসমাজও এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলছে, এখানে পর্যটন বিকশিত হলে তারা গাইড, খাবারের দোকান, নৌকা সেবা—এসবের মাধ্যমে কাজ করে আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপের গুরুত্ব
পরিবেশবিদরা মনে করছেন, চাকিরপশার বিল শুধু একটি প্রাকৃতিক জলাশয় নয়, এটি স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। তাই পর্যটন উন্নয়নের পাশাপাশি সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি।
•পরিবেশবিদদের পরামর্শ: প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যেন বিলের পানি প্রবাহ, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র এবং অতিথি পাখিদের আবাসস্থল কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে।
চাকিরপশার বিল শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যের নিদর্শন নয়, এটি স্থানীয় মানুষের জীবিকা ও সংস্কৃতিরও অংশ। পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ঘটলে এই বিল একদিন দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হতে পারে—যেখানে মিলবে প্রকৃতি, শান্তি ও জীবিকার সুষম সমন্বয়।
দ.ক.সিআর.২৫