কালনেত্র প্রতিবেদন: বাংলা শুধু নদীমাতৃক ভূমিই নয়, ছিল সমুদ্রের গর্বিত কন্যা। অসংখ্য নদী, খাল আর উপকূল তাকে বানিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার নৌ-উদ্যোক্তা কেন্দ্র। প্রাচুর্যপূর্ণ বনভূমির কাঠ আর কারিগরদের নিপুণ হাতে গড়ে উঠেছিল এমন এক শিল্প, যা বাংলাকে একসময় বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড় করিয়েছিল।
জাহাজ নির্মাণের স্বর্ণযুগ চট্টগ্রাম ছিল সেই সময়ের “Shipbuilding hub of Bengal”। এখানকার ডাঙায় দাঁড়িয়ে শত শত জাহাজ একসাথে তৈরি হতো। সন্দীপ, সোনারগাঁও, গৌড়, বিক্রমপুর, বরিশাল কিংবা নরসিংদীর কারিগররা যেন সমুদ্রের স্বপ্নকে কাঠে রূপ দিতেন। সুন্দরবনের গরান, সুন্দরী, সেগুন, মহগনি কাঠ কেবল জাহাজ নয়, ছিল একেকটি অমর স্মারক—যা লবণাক্ত ঢেউয়ের আঘাতে পর্যন্ত সহজে ভেঙে পড়ত না।
সমুদ্রপথে বাংলার পরিচয়
১০ম শতক থেকেই আরব ব্যবসায়ীরা বাংলার জাহাজে ভর করে দূরদেশে পাড়ি জমাত। ১৫শ শতকে মিং রাজবংশের চীনের সাথে তুলা, সিল্ক আর মসলার বাণিজ্যে বাংলার নৌযান ছিল অপরিহার্য। পরে ডাচ, পর্তুগিজ, ফরাসি থেকে শুরু করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি—সবাই বাংলার জাহাজ কিনে ইউরোপীয় সাগর জয় করেছে। এমনকি মুঘল সাম্রাজ্যের যুদ্ধজাহাজও বাংলার কারিগরদের হাতে গড়ে উঠেছিল।
মানে অতুলনীয়, প্রযুক্তিতে অগ্রগণ্য: বাংলার কারিগররা জানতেন কীভাবে সস্তায়, অল্প সময়ে, দীর্ঘস্থায়ী জাহাজ বানাতে হয়। ১০০ টন থেকে শুরু করে ৮০০ টন পর্যন্ত ভারবাহী জাহাজ নির্মাণ হতো এখানে। ইংরেজ ইতিহাসবিদ জেমস বাসে অকপটে লিখেছিলেন—“Bengal-built ships last longer and cost half as much as European ships.” বাংলার জাহাজ মানেই ছিল শক্তি, আস্থা আর স্থায়িত্বের প্রতীক।
পতনের সূচনা: কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস—১৭৫৭ সালে দেশ দখলের পর যখন ইংরেজরা ক্ষমতায় এলো, তখন এই শিল্পের অবসান ঘটলো। ইউরোপীয় বাজারকে নিজেদের দখলে রাখতে ব্রিটিশরা আইন জারি করলো যাতে ভারতীয় জাহাজ বিক্রি না হয়। স্থানীয় জাহাজে বাড়তি কর চাপানো হলো, অথচ ইউরোপীয় জাহাজ পেল সুবিধা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবল ইউরোপীয় জাহাজ ব্যবহার শুরু করলো। দক্ষ কারিগররা কাজ হারিয়ে কৃষিজীবী বা সাধারণ শ্রমজীবী হয়ে পড়লেন। একে একে নিভে গেল এক মহৎ ঐতিহ্যের প্রদীপ।
ইতিহাসের গর্বিত সাক্ষী: তবুও ইতিহাস গোপন করেনি বাংলার গৌরব। ১৮০১ সালে চট্টগ্রামে তৈরি যুদ্ধজাহাজ “HMS Asia” ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত হয়েছিল। নথিতে পাওয়া যায়—বাংলার তৈরি জাহাজের আয়ুষ্কাল ইউরোপীয় জাহাজের দ্বিগুণ। নৌ-ইতিহাসবিদরা একে বিশ্বের অন্যতম টেকসই শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ এখনও নদীমাতৃক দেশ। আমাদের হাতে আছে শ্রমশক্তি, আছে ঐতিহ্য, আছে ইতিহাস। যদি আধুনিক প্রযুক্তির সাথে এই ঐতিহ্যকে যুক্ত করা যায়, তবে শিপবিল্ডিং শিল্প আবারও হতে পারে বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের অন্যতম হাতিয়ার। নদী ও সমুদ্রের সন্তান এই জাতি আবারো প্রমাণ করতে পারে—বাংলার জাহাজ আজও সমুদ্রকে জয় করতে পারে।
ইতিহাস শুধু পড়ার জন্য নয়, জেগে ওঠার জন্য। প্রশ্ন হলো—আমরা কি আবারো বাংলার সেই জাহাজশিল্পকে পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনতে প্রস্তুত?
দ.ক.সিআর.২৫