তানভীর আহমদ রাহী, কালনেত্র: চট্টগ্রামে প্রতি বছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সমাবেশগুলোর একটি ঐতিহ্যবাহী জশনে জুলুস। এবারও শনিবার সকাল থেকে নগরের আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে ওঠে হামদ, নাত, দরুদ শরিফ, তাকবির ও জিকিরে। নগরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসতে থাকেন নানা বয়সী মানুষ। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ধর্মীয় আবহ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ষোলশহর এলাকায়।
জুলুসের সূচনা
ঐতিহাসিক এই জশনে জুলুসের সূচনা হয় শনিবার সকাল সোয়া ১০ টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহরের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ থেকে। কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই মাঠে জমতে শুরু করেন ভক্ত-অনুরাগীরা। কেউ এসেছেন হেঁটে, কেউবা দল বেঁধে ট্রাক, মাইক্রোবাস ও পিকআপে চড়ে। সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষও যোগ দেন এই মিলনমেলায়। হাতে পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন ও নানা ধর্মীয় শ্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। পথিমধ্যে ভক্তদের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি, শরবত ও শুকনা খাবার বিতরণ করতে দেখা যায়।
নেতৃত্ব ও অতিথি
এবারের ৫৪তম জুলুসে নেতৃত্ব দেন সৈয়দ মুহাম্মদ সাবের শাহ। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শাহজাদা সৈয়দ মুহাম্মদ কাসেম শাহ ও সৈয়দ মুহাম্মদ মেহমুদ আহমদ শাহ। আয়োজক সংগঠন আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট জানায়, ১৯৭৪ সালে আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.) প্রথম এই জুলুসের প্রবর্তন করেন। সেই থেকে প্রতিবছর নিয়মিতভাবে এটি আয়োজিত হয়ে আসছে এবং আজ তা চট্টগ্রামের অন্যতম ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
জুলুসের রুট পরিবর্তন
প্রতিবছর জুলুস জামেয়া মাদ্রাসা মাঠ থেকে শুরু হয়ে নগরের বিবিরহাট, মুরাদপুর, কাতালগঞ্জ, চকবাজার, জামালখান, কাজীর দেউড়ি, ওয়াসা, জিইসি, ২ নম্বর গেট ঘুরে পুনরায় জামেয়া মাঠে শেষ হয়। তবে এ বছর নিরাপত্তার স্বার্থে রুট কিছুটা ছোট করা হয়। ষোলশহর থেকে শুরু হয়ে মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট ও জিইসি মোড় ঘুরে একই পথে জুলুস ফিরে আসে। আনজুমান ট্রাস্টের মুখপাত্র মোছাহেব উদ্দিন বলেন, “পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশাসনের অনুরোধে আমরা রুট ছোট করেছি। তবে এতে জুলুসের আবহ, উচ্ছ্বাস কিংবা আধ্যাত্মিকতা কোনোভাবেই কমেনি।”
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
এ বিশাল সমাবেশকে ঘিরে নগরজুড়ে নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নগর পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়। যানজট এড়াতে কিছু সড়কে বিকল্প রুট ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ছুটির দিন হওয়ায় নগরে স্বাভাবিকভাবেই যানবাহনের চাপ কিছুটা কম ছিল, ফলে বড় ধরনের ভোগান্তি হয়নি।
ধর্মপ্রাণ মানুষের উচ্ছ্বাস
ভোর থেকেই দেখা যায়, মাদ্রাসা মাঠে দল বেঁধে আসছেন মানুষজন। হাতে সবুজ পতাকা, কণ্ঠে দরুদ শরিফ, বুকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। কারও হাতে বড় ব্যানার, কারও হাতে ইসলামি শ্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড। মাদ্রাসা মাঠ থেকে জুলুস শুরু হতেই সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানান অংশগ্রহণকারীদের। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে জুলুস রূপ নেয় বিশাল ধর্মীয় উৎসবে।
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা
১৯৭৪ সালে শুরু হওয়া এই জুলুস এখন চট্টগ্রামের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতির অন্যতম অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই জশনে জুলুসে লাখো লাখো মানুষ অংশগ্রহণ করেছে, অনেকের মতে কোটি মানুষ এমনটাও ধারণা করা হয়। যা শুধু ধর্মীয় আবেগ নয়, বরং ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইসলামের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায়।
দ.ক.সিআর.২৫