ড. তপন দেববর্মা, চুনারুঘাট: “প্রান্তিক অর্থনৈতিক আচরণ” শব্দটি এমন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক চর্চাকে বোঝায় যারা আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রান্তে অবস্থান করে। এসব গোষ্ঠীতে প্রায়শই আদিবাসী জনগণ, বননির্ভর সম্প্রদায়, অনানুষ্ঠানিক শ্রমিক এবং ন্যূনতম জীবিকানির্ভর পরিবার অন্তর্ভুক্ত থাকে। বন অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে, এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, অ-দাতব্য বনজ সম্পদ (NTFP) আহরণ, ক্ষুদ্র কৃষিকাজ বা মৌসুমি শ্রমের মতো বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকে—যা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, নিয়ন্ত্রণ বা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অংশ নয়।
আধুনিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে, এই প্রান্তিক অর্থনীতির আচরণ বিশ্লেষণ করা বন ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তুতন্ত্রের স্থায়িত্ব বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশ্লেষণের জন্য আয়, সম্পদ ব্যবহারের ধরন, শ্রম-যোগদান, ভূমি ব্যবহারের অধিকার ও সামাজিক গতিশীলতা সংক্রান্ত পরিমাণগত ও গুণগত তথ্য সংগ্রহ, সংগঠন ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে কাজ করা হয়।
আধুনিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে হাউসহোল্ড জরিপ, জিআইএস ম্যাপিং, অর্থনৈতিক মডেলিং, অংশগ্রহণমূলক গ্রামীণ মূল্যায়ন এবং ভ্যালু চেইন বিশ্লেষণের মতো টুল ব্যবহৃত হয়। এসব উপায়ে বোঝা যায়, কীভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বন সম্পদের ওপর নির্ভর করে, বনজ পণ্যের আয় নমনীয়তা (income elasticity) কতটা, এবং পরিবেশগত অবনতি বা নীতিগত পরিবর্তনে তাদের কতটা ঝুঁকি তৈরি হয়।
এই বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল প্রান্তিক গোষ্ঠীর আয়-সংক্রান্ত আচরণ। অধিকাংশ বননির্ভর পরিবার বিভিন্ন আয়ের উৎসে নির্ভরশীল—যেমন মৌসুমি বনজ সম্পদ সংগ্রহ (মধু, বাঁশ, ওষধি গাছ), গবাদিপশু চরানো বা কাঠকয়লা তৈরি। তাদের অর্থনৈতিক আচরণ গঠিত হয় তাৎক্ষণিক জীবিকা, সীমিত মূলধন, দুর্বল বাজার সংযোগ এবং দুর্বল সম্পত্তি অধিকারের মাধ্যমে। ডেটা বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, তাদের উল্লেখযোগ্য আয় বনজ সম্পদ থেকে আসে, এবং বন প্রবেশাধিকার ব্যাহত হলে তাদের অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করে।
আরেকটি প্রধান বিশ্লেষণ ক্ষেত্র হলো ভোগব্যবহার ও শ্রমের ধরন। প্রান্তিক অর্থনীতিতে আত্মনির্ভরতা এবং অমুদ্রিক বিনিময়ের হার বেশি। শ্রম এখানে অনানুষ্ঠানিক, পারিবারিক, এবং জাতীয় পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয় না। অর্থনৈতিক তথ্য অনুযায়ী, এসব অঞ্চলে নারী ও শিশুরা বনে-সম্পৃক্ত কাজে অতিমাত্রায় জড়িত, বিশেষ করে যেখানে পুরুষেরা কর্মসংস্থানের জন্য বাইরে চলে যায়।
নীতিনির্ধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই আচরণগত বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক বন ব্যবস্থাপনা কৌশল যেমন REDD+ (দাবি হ্রাস ও বনধ্বংস প্রতিরোধ), কমিউনিটি ফরেস্ট্রি, এবং কার্বন ট্রেডিং – এসব কার্যক্রম সফল করতে হলে প্রান্তিক অর্থনৈতিক আচরণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। অন্যথায়, এসব নীতি ভুলভাবে এই জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এছাড়াও, প্রান্তিক অর্থনীতির বাস্তুসংস্থানগত প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না। যদিও এরা সাধারণত নিম্ন মাত্রার আহরণ চর্চা করে, তবে জনসংখ্যার চাপ, বাজার চাহিদা এবং বনাঞ্চলের সংকোচন এদেরকে অনিচ্ছাকৃতভাবে অস্থিতিশীল ব্যবহারের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আধুনিক অর্থনীতি এখানে খরচ-সুবিধা বিশ্লেষণ, পরিবেশগত মূল্যায়ন এবং টেকসই সূচকের মতো টুল ব্যবহার করে জীবিকা ও পরিবেশের ভারসাম্য নির্ধারণ করে।
সারাংশে, “বন অর্থনীতিতে প্রান্তিক অর্থনৈতিক আচরণের ডেটা বিশ্লেষণ” একটি আন্তঃবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ক্ষেত্র। এটি অর্থনৈতিক টিকে থাকা, সম্পদ শাসন এবং পরিবেশগত টেকসইতাকে একত্রিত করে, ডেটাভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর বন ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা প্রদান করে – যা আধুনিক অর্থনৈতিক তত্ত্বের আলোকে পরিচালিত হয়।
লেখক, তপন দেববর্মা, বন অর্থনীতি বিশ্লেষক, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক ছাত্র ও অর্থনীতিতে পিএসডি
দ.ক.সিআর.২৫