➖
কালনেত্র প্রতিবেদন
বিশ্বজুড়ে শ্রমিক অধিকার ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (আইটিইউসি)। গ্লোবাল রাইটস ইনডেক্স–২০২৫ অনুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীর সব মহাদেশেই শ্রমিক অধিকার চরম হুমকির মুখে রয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠনগুলোর জোট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমিক অধিকারের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ দশটি দেশের তালিকায় রয়েছে—বাংলাদেশ, বেলারুশ, ইকুয়েডর, মিসর, সোয়াজিল্যান্ড, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, তিউনিসিয়া ও তুরস্ক।
বিভিন্ন দেশে ডানপন্থি রাজনীতিবিদ ও তাদের ধনকুবের মিত্ররা শ্রমিকদের অধিকার হরণ করছেন। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইলন মাস্ক, আর্জেন্টিনায় হাভিয়ের মিলেই ও এদুয়ার্দো ইউরনেকিয়ানের মতো ব্যক্তিদের কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী ও বৈষম্যমূলক আচরণে লিপ্ত।
প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের সম্মিলিত অধিকার ধ্বংসে ট্রাম্প প্রশাসন বুলডোজার চালাচ্ছে। শ্রমবিরোধী ধনকুবেরদের সরকার পরিচালনায় প্রভাবশালী অবস্থানে বসিয়েছে।
সূচক অনুযায়ী, ট্রাম্প প্রশাসন শ্রমিক অধিকারের পরিপন্থি বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—পরিবহণ নিরাপত্তা প্রশাসনের ৪৭ হাজার কর্মীর ইউনিয়ন সুরক্ষা বাতিল, ফেডারেল কর্মীদের একটি বড় অংশের নাগরিক সেবা সুরক্ষা প্রত্যাহারের চেষ্টা ও জাতীয় শ্রমিক সম্পর্ক বোর্ডের একজন সদস্যকে বরখাস্ত করা, যাতে বোর্ডে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সদস্য না থাকে।
আইটিইউসির মহাসচিব লুস ট্রায়াঙ্গেল বলেছেন, প্রতিবেদনটি ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয়েছে। তার মতে, এরপর যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
লুস ট্রায়াঙ্গেল আরও জানান, ট্রাম্প প্রশাসন ফেডারেল মধ্যস্থতা ও সমঝোতা সেবা সংস্থার কর্মীসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছে ও ফেডারেল লেবার রিলেশনস অথরিটির একজন সদস্যকেও বরখাস্ত করেছে। পাশাপাশি একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে অধিকাংশ ফেডারেল কর্মীর সম্মিলিত দর-কষাকষির অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
ট্রায়াঙ্গেল বলেন, অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতারা ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রবিরোধী আচরণ করছেন। তাদের প্রথম লক্ষ্যই হচ্ছে শ্রমিকদের অধিকার দমন। কারণ শ্রমিকরাই সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক শক্তি। এ কারণে আমরাই তাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা।
শ্রমিক অধিকার পরিস্থিতির অবনতি
প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনটি মহাদেশে শ্রমিক অধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। এর মধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপের পরিস্থিতি ২০১৪ সালে সূচক চালুর পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ১৫১টি দেশের মধ্যে মাত্র ৭টি দেশ শ্রমিক অধিকার সূচকে শীর্ষ রেটিং পেয়েছে। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৮টি।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ৭২ শতাংশ দেশে শ্রমিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সীমিত, যা সূচক চালুর পর থেকে সবচেয়ে খারাপ রেকর্ড। এ ছাড়া, ৮৭ শতাংশ দেশে ধর্মঘটের অধিকার ও ৮০ শতাংশ দেশে সম্মিলিত দর-কষাকষির অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।
শ্রমিক অধিকারের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ দশটি দেশের তালিকায় রয়েছে—বাংলাদেশ, বেলারুশ, ইকুয়েডর, মিসর, সোয়াজিল্যান্ড, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, তিউনিসিয়া ও তুরস্ক। শুধু অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো ও ওমান—এই তিনটি দেশে গত বছরের তুলনায় শ্রমিক অধিকার সূচকে উন্নতি হয়েছে।
অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা
লুস ট্রায়াঙ্গেল সতর্ক করে বলেছেন, এই রাজনীতিবিদদের পেছনে থাকা ধনকুবেররা এখন আর ছায়ায় নেই, তারা সামনে এসে বিশ্বের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে নিচ্ছে। শ্রমিক অধিকার ধ্বংসের এটিই মূল চালিকাশক্তি। তিনি আরও বলেন, গত ৪ থেকে ৫ বছরে কোভিড-১৯ ও মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছে। এই দুরবস্থার সুযোগ নিয়েই চরমপন্থি দলগুলো ভোট টানছে, যদিও তারা শ্রমজীবী মানুষের জন্য কোনো বাস্তব সমাধান দিচ্ছে না।
ট্রায়াঙ্গেল বলেন, গত পাঁচ বছরে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ধনকুবেরের সম্পদ দ্বিগুণ হয়েছে, অথচ এই সময়েই বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ লাখ কোটি ডলার ব্যয় হচ্ছে অস্ত্রের পেছনে, অথচ অধিকাংশ দেশেই একটি ন্যায্য করব্যবস্থা নেই। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে শ্রমজীবী মানুষদের আরও বেশি মজুরি, ভালো চাকরি, অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
দ.ক.সিআর,২৫