➖
আসাদ ঠাকুর, অমনিবাস◾
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন আর শুধু ভৌগোলিক সীমারেখা নয়, এটি হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার এক আয়না, যেখানে প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হচ্ছে এক রাষ্ট্রের মানবাধিকার-সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতির চিত্র। ২০২৫ সালের মে মাস এই সংকটকে নতুন মাত্রায় উন্মোচিত করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মানুষ—নারী, পুরুষ ও শিশু—রাতের অন্ধকারে, গহীন বনাঞ্চল ও নদীপথে সীমান্ত পেরিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কখনো কখনো ন্যূনতম মানবিক মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ না রেখে।
শুধু একটি কিংবা দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সুনির্দিষ্ট নীতিগত ধারা অনুসরণ না করে বিভিন্ন রাজ্য থেকে অসংখ্য ব্যক্তিকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে। কেউ মাসের পর মাস কাটিয়েছেন ভারতের আটক শিবিরে, কাউকেবা আবার আকস্মিকভাবে আটক করে সীমান্তের নির্জন স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, সুন্দরবনের দুর্গম অঞ্চলে ৭৮ জন মানুষকে খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়; আবার ফেনী নদীতে রাতে পাঁচ জন নারী ও শিশুকে প্লাস্টিক বোতলে বাঁধা অবস্থায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে—যা হয়তো সীমান্তরক্ষীদের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ না থাকলে প্রাণঘাতী পরিণতি ডেকে আনত।
আরও শিউরে-ওঠা দৃষ্টান্ত মিলেছে আন্দামান সাগরে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় “বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন” উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, দিল্লি থেকে আটক করা অন্তত চল্লিশ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ৮ মে সামরিক নৌযানে তুলে মিয়ানমার উপকূলসীমার কাছে সাগরে নামিয়ে দেওয়া হয়; তাদের হাতে শুধু লাইফ জ্যাকেট ছিল। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর জাতিসংঘের মিয়ানমার-সংক্রান্ত বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুজ একে “আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন” আখ্যা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছেন।
এইসব ঘটনা কেবল মানবিক সংকট নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে গভীর প্রশ্ন তোলে। জাতিসংঘ-নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী কিংবা ভারতের আদালতে বিচারাধীন নাগরিকত্ব-মামলার ব্যক্তিরাও এই প্রক্রিয়ার বাইরে থাকেননি—যেমন শিক্ষক খায়রুল ইসলামের চোখ বেঁধে নির্যাতনের পর পুশ-ইন, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রীতিনীতির পরিপন্থী।
এই প্রবণতা সাময়িক নয়; এটি একটি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে অন্তর্নিহিত “বর্জননীতির” বহিঃপ্রকাশ, যেখানে ‘নাগরিকত্ব’ নির্ধারিত হয় শ্রেণিবিন্যাস ও প্রশাসনিক বৈধতার ভিত্তিতে, ন্যায়ের নয়। প্লেটোর The Republic-এ যে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়, সেখানে রাষ্ট্র তার দুর্বলতম নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদান করে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ভারতে আমরা এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট দেখি—যেখানে শরণার্থী, সংখ্যালঘু এবং শিশুদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা না দিয়ে নির্বাসনের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো যেভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে শুধু বলপ্রয়োগ নয়, বরং প্রশাসনিক নিরীক্ষা ও শ্রেণিব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত বলেছিলেন—ভারতের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন প্রকল্প (NRC) তার এক বাস্তব উদাহরণ। এই প্রকল্পের আওতায় বংশপরিচয়, ডিজিটাল রেকর্ড এবং আবাসিক তথ্যের ভিত্তিতে মানুষকে বৈধ-অবৈধ, অন্তর্ভুক্ত-বর্জিত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে; ফলে বহু ব্যক্তি কার্যত সিভিল ডেথ বা সামাজিক মৃত্যুর মুখে পড়ছেন।
ভারতের রাজনৈতিক বক্তব্য ও নীতির মধ্যে আজ পুনরায় বিভাজনের ভাষা ফিরে এসেছে, যা ১৯৪৭ সালের বিভক্তির সময়কার Two-Nation Theory-এর প্রতিধ্বনি বহন করে। অথচ ৭ দশক ধরে কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল ভারতের মহত্ব! রোহিঙ্গা কিংবা বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে চলমান নীতিমালা ঘৃণা-ভিত্তিক রাজনীতিকে উৎসাহিত করছে; এর ফলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
ভারত যদিও ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের সদস্য নয়, তথাপি আন্তর্জাতিক প্রথা ও আইন—বিশেষত non-refoulement নীতি—এর প্রতি সে দায়বদ্ধ, যা বলে কোনো শরণার্থীকে এমন স্থানে পাঠানো যাবে না যেখানে তার প্রাণ বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। পাশাপাশি, ভারত আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত চুক্তি (ICCPR) এবং শিশু অধিকারের কনভেনশন (CRC)-এর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র—যেগুলো প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা ও বিচারিক অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে। এমন বাস্তবতায়, বিচারিক পর্যালোচনা ছাড়াই পুশ-ইন নীতির বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও মানবিক মানদণ্ডের পরিপন্থী বলেই প্রতীয়মান হয়।
সীমান্তে যা ঘটছে, তা একটি রাষ্ট্রের নৈতিক অবয়বের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়। আজকের ভারতের প্রতিচ্ছবিতে দুর্বলদের পাশে রাষ্ট্র নেই; বরং রাষ্ট্র নিজেই এক বৃহৎ নিরাপত্তা কাঠামোর অংশ হয়ে উঠেছে, যার কাজ পরিচয় মুছে দেওয়া, মানুষকে শ্রেণিবদ্ধ করা এবং অসহায়দের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে ঠেলে দেওয়া।
ফরাসি সমাজবিদ ব্রুনো লাতুর রাষ্ট্রের বৈধতাকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক আস্থা ও নৈতিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে। কিন্তু যখন বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক কাঠামো টিকে থাকে অথচ নৈতিক জবাবদিহিতা বিলুপ্ত হয়, তখন একটি রাষ্ট্র কাঠামো হিসেবে থাকে বটে, কিন্তু সেটিকে আর কার্যকর রাষ্ট্র বলা যায় না।
ভারতে আজো নির্বাচন হয়, কিন্তু নির্বাচন আর গণতন্ত্র সমার্থক নয়। গণতন্ত্র মানে শুধুই ব্যালট নয়; এটি আইনের শাসন, সংখ্যালঘু অধিকার এবং নাগরিক মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধার প্রশ্ন। আজকের ভারতের ভেতর যে বিভাজন ও সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ভাষ্য জোরদার হচ্ছে, তা সেই গণতন্ত্রের আত্মাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (CAA), NRC এবং পুশ-ইন প্রক্রিয়া কেবল অভিবাসন-নীতি নয়; এগুলো ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের আত্মিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বহুত্ববাদ যেখানে এক সময় ছিল রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রবিন্দু, এখন সেখানে পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও ভয়ের রাজনীতি স্থান দখল করেছে।
নদীতে ভেসে যাওয়া শিশু, চোখ-বাঁধা শিক্ষক, কিংবা আন্দামান সাগরে ফেলে দেওয়া রোহিঙ্গা—এসব চিত্র কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতীক নয়; বরং এটি এমন এক রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি, যেটি নিজের ভিন্নতা-সহিষ্ণুতাকেই আজ বোঝা মনে করছে।
যদি রাজনৈতিক সুবিধাবাদের তাড়নায় এইসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকে, তবে তা ভারতের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্বের দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। রাষ্ট্রের শক্তি আসে দায়িত্বশীলতা থেকে, আর সেই দায়িত্ব হলো সবচেয়ে দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আজ ভারতের সামনে সেই নৈতিক প্রশ্নই দাঁড়িয়ে আছে—সে কি বিভাজনের পথেই এগোবে, নাকি বহুত্ব ও মানবিকতার মূল্যে নিজের অবস্থান পুনর্গঠন করবে?
দ.ক.সিআর.২৫