➖
আসাদ ঠাকুর, অমনিবাস◾
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে যতজন প্রবাদপ্রতিম পুরুষ আলোকিত করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য হচ্ছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এর প্রধান কারণ; বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ যখনই কোনো সংকটে পড়েছে ; ঠিক তখনই তাদের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি, দিয়েছেন সঠিক দিকনির্দেশনা। নিজের, নিজের পরিবারের জীবন বিপন্ন হবে জেনেও সমস্ত মানসিক, শারীরিক শক্তি দিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
১৯৭১ সালে যখন এ দেশের মানুষ দিশাহীন, কি হচ্ছে, কি ঘটবে, কি করতে হবে; কোনো ধরনের দিক নির্দেশনা নেই মানুষের কাছে, ঠিক সেই সময়ই মানুষের হৃদয়ে আশার আলো হয়ে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ভেসে উঠল বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ” আমি মেজর জিয়া বলছি”!
এই সময়োচিত ও যথাযথ স্বাধীনতার ঘোষণা মুক্তিকামী জনতার মধ্যে এক ধরনের নতুন প্রাণসঞ্চার করে! তারা নিজেদেরকে এক একটা স্ফুলিঙ্গের মত মনে করতে থাকে। ঝাপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। এর একটা অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধের উপ অধিনায়ক এ, কে খন্দকারের বয়ানে! তিনি বলেন” আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি, যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও জানি যে মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারা দেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে!”( মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর, পৃষ্ঠা ৩০, প্রথমা প্রকাশন)
জিয়াউর রহমান ছিলেন একাধারে সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের প্রধান। তিনি সম্মুখ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অতুলনীয় অবদান রেখেছেন। পুরো যুদ্ধের সময় তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানদের কথা চিন্তা না করে স্বাধীনতাকামী মানুষের জনযুদ্ধকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় দিবস ৩০ মে। ঠিক যেই শহর থেকে তিনি এই দেশকে পরাধীনতার কবল থেকে মুক্ত করার জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, সেই শহরেই সার্কিট হাউসে কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যরা তাকে হত্যা করেন।
বাংলাদেশ যখন জিয়াউর রহমানের সুদৃঢ় নেতৃত্বে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে সমৃদ্ধশালী দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে উজ্জ্বল হচ্ছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতি তার নিজের ভিত্তি তৈরি করছিল, ঠিক সেই সময়ই তাকে হত্যা করা হয়। জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস শুরু হয়।
১৯৭৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর বি এন পি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে নতুন ধরনের রাজনীতির দিগন্ত উন্মোচন করেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে যারাই বসবাস করে, তার হোক মুসলমান, হোক হিন্দু, হোক বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান, হোক উপজাতি, হোক বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী তারা সবাই বাংলাদেশি। এই অসাধারণ মতবাদকে সামনে নিয়ে তিনি গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ান। প্রণয়ন করেন বিএনপির রাজনীতির মূলভিত্তি ১৯ দফা। এই ১৯ দফা তখনকার সময় এতই যুগান্তকারী ও সময়োচিত রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ছিল যে, এর প্রয়োগে শেখ মুজিবের অপশাসন থেকে দেশ আস্তে আস্তে সুশাসনের দিকে ধাবমান হতে থাকে।
জিয়াউর রহমানের খাল খনন কর্মসূচি এতটাই সফল একটা পদক্ষেপ ছিল যে, আজকের বাংলাদেশেও এটা সমভাবে প্রাসঙ্গিক। খাল খনন কর্মসূচি র মাধ্যমে তিনি কৃষিতে একটি বিপ্লবের সূচনা করেন। কৃষকদের কে প্রতিনিয়ত মোটিভেট করেন উৎপাদন দ্বিগুণ করার জন্য, কোনো অনাবাদি জমি না রাখার জন্য।
দেশের অর্থনীতির চাকাকে মজবুত করার জন্য শিল্পায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। দেশে প্রথম গার্মেন্ট শিল্পের শুভসূচনা হয় জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই ১৯৮০ সালে; দেশ গার্মেন্টস বাংলাদেশের প্রথম গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি । আজ এই গার্মেন্টই বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত।
জিয়াউর রহমান মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সবাইকে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যাবসা করার সুব্যবস্থা করে দেন।
শিশু কিশোরদের সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য “নতুন কুঁড়ি” প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন যা বিটিভির মাধ্যমে পরিচালিত হত। এখনও মানুষের কানে বাজে “আমরা নতুন, আমরা কুঁড়ি নিখিল বন নন্দনে” প্রমো গানটি। ১৯৭৬ সালে দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিদের জন্য প্রবর্তন করেন একুশে পদক। ১৯৭৭ সালের ২৬ মার্চ থেকে জাতীয় পর্যায়ে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা বাংলাদেশিদের জন্য প্রবর্তন করেন স্বাধীনতা পুরস্কার!
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতকে এভাবেই জিয়াউর রহমান এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। জিয়াউর রহমান প্রথম বাংলাদেশি যাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তার বাসভবন হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এটা ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর সাফল্য! তিনি মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা সব মহলেই সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিয়াউর রহমান নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন।
এশিয়ান দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সার্ক ( SAARC) গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। একজন সত্যিকারের ভিশনারি লিডার হিসেবে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বলতেন, ” সমষ্টিগত স্বেচ্ছাশ্রম কোনোদিন বৃথা যায় না। কারও মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, নিজ শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে স্থানীয় সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে।”
জিয়াউর রহমানের সততা ছিল সর্বজনবিদিত। তাঁর প্রচণ্ড সমালোচকও কোনো দিন তার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন নি। জিয়াউর রহমানের ভারত সফরের সময় ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে জিয়াউর রহমান ও তাঁর পরিবারকে চারটি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশে ফিরে সেই ঘড়িও জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছিলেন; কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, তিনি যদি রাষ্ট্রপতি না হতেন তাহলে ত এই উপহার পেতেন না। এতটাই সৎ ছিলেন তিনি নিজের দেশের প্রতি। বি এন পি’র বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমানের একটা সাক্ষাৎকারে শোনা যায়, তিনি বলছেন কীভাবে উনার বাবার প্যান্ট, শার্ট দর্জি দিয়ে ছোট করে পড়তে হত বাবার নির্দেশে। একজন সৎ রাষ্ট্র নায়ক একটা দেশের জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
খুবই অল্প সময় পেয়েছেন তিনি একটি ভঙ্গুর দেশকে সুদৃঢ় ভিত্তি দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশের অর্থনীতি, সামাজিক সংস্কার, পররাষ্ট্রনীতি সবকিছুরই পজিটিভ শুরুটা হয়েছে উনার হাত ধরে। জিয়াউর রহমান বলতেন” আমাদের হাত কোটি হাতিয়ার, অঙ্গীকার আমাদের দেশ গড়বার!”( আশা নিরাশার উলশী, মাহফুজউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, পৃষ্ঠা:২১৫)
তাঁর প্রয়াণ দিবসে জাতির এই সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে ভিত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গড়ে দিয়ে গেছেন, বাংলাদেশের গণমানুষ এই জন্য তাকে আজীবন কৃতজ্ঞ চিত্তে প্রতিনিয়ত স্মরণ করবে।
asadtagore@yahoo.com
দ.ক.সিআর.২৫