
নাজমুল ইসলাম হৃদয়, বাহুবল : অসুস্থতার মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তার পর মানুষের প্রথম ভরসা—চিকিৎসক। সেই মহৎ পেশায় যিনি সেবা, দায়িত্ব ও মানবিকতাকে একত্রে ধারণ করে মানুষের মন জয় করেছেন তিনি হবিগঞ্জের বাহুবল ৫০ শয্যা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মিজানুর রহমান শাহীন।
চিকিৎসাসেবা শুধু পেশা নয়, এটি একটি শিল্প—যেখানে প্রয়োজন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, মনোযোগ, ধৈর্য ও মানবিকতা। ডাক্তার শাহীন তার কর্মে সেই শিল্পকে রূপ দিয়েছেন অনন্য দক্ষতায়। রোগীর প্রতি তার উত্তম ব্যবহার, মনোযোগী আচরণ, রোগ নির্ণয়ে পারদর্শিতা, সঠিক চিকিৎসা প্রয়োগ এবং অনাবিল মুন্সিয়ানা তাকে করে তুলেছে বাহুবলবাসীর আস্থার প্রতীক।
রোগী ও অভিভাবকদের অভিমত, তার হাসিমুখে কথা বলা এবং রোগীর সমস্যার কথা ধৈর্য ধরে শোনার কারণে চিকিৎসা শুরুর আগেই রোগীর ২০ শতাংশ মানসিক স্বস্তি চলে আসে। শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি জনপ্রিয়তা পেলেও মেডিসিন, বক্ষব্যাধী, ডায়াবেটিস, বাতব্যথা, অ্যাজমা ও অ্যালার্জিসহ নানান রোগের চিকিৎসায় সমান দক্ষ।
মানবিক চিকিৎসক হিসেবে তার পরিচিতি অবিভক্ত। দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের চেম্বারে ফি ছাড়াই চিকিৎসা দেন তিনি। অপ্রয়োজনে চিকিৎসা পরীক্ষা দেন না। রোগীরা জানান, তার কাছে নির্ভয়ে সব বলা যায়, কারণ তিনি কখনোই বাড়তি পরীক্ষা বা ওষুধ চাপিয়ে দেন না।
মহামারী করোনার ভয়াবহ সময়ে যখন অনেকে নিজেকে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল, তখনো ডা. মিজানুর রহমান শাহীন ছিলেন ফ্রন্টলাইন ফাইটার। হাসপাতাল ছাড়েননি একদিনও। জীবনবাজি রেখে রোগী সেবা দিতে গিয়ে তিনিও আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়। সুস্থ হয়ে আবারও কাজ শুরু করেন আগের মতোই উদ্যম নিয়ে। কারও আইসিইউ লাগলে, কারও হাসপাতালের সিট প্রয়োজন হলে, আবার কারও প্লাটিলেট না থাকলে—সব কিছু একাই সমাধান করে দিয়েছেন তিনি। এমনকি অনেক সময় রোগীকে হাসপাতালে আনতে নিজেই এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছেন।
বাহুবল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তিনি ১৫০–২০০ রোগী দেখতেন। চিকিৎসকের সংকট থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালের আউটডোর কার্যক্রমের বড় অংশই নির্ভর করত তার ওপর। দায়িত্বশীলতা, কর্মনিষ্ঠা ও সহযোগিতামূলক মনোভাব তাকে সহকর্মীদের কাছেও করে তুলেছে শ্রদ্ধাভাজন।
জনবান্ধব এই চিকিৎসক ন্যায়বিচার ও নৈতিকতায় ছিলেন আপসহীন। দরিদ্র, অসহায় বা বিপদে পড়া মানুষ যখন তার কাছে এসেছে, তখন তিনি ছিলেন তাদের প্রথম আশ্রয়। এজন্যই তিনি আজ বাহুবলের মানুষের কাছে শুধু একজন সরকারি কর্মকর্তা নন, বরং নির্ভরতার বাতিঘর।
নিজের মানবিকতার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. মিজানুর রহমান শাহীন বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই মানুষকে ভালোবাসি, মানুষের দুঃখ-কষ্ট আমার মনে দাগ কাটত। তখনই স্বপ্ন দেখেছিলাম — বড় হবো, মানুষের পাশে দাঁড়াবো। চিকিৎসক হওয়ার পর মনে হয়েছে, আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগই দিয়েছেন। তাই নিজেকে কখনো চাকুরিজীবী মনে করি না; নিজেকে একজন সেবক, একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে দেখি। রোগী যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে, তাদের হাসিমুখটাই আমার সবচেয়ে বড় অর্জন। আমার কাছে রোগী মানে শুধু প্রেসক্রিপশন নয়। রোগীর ভয়, উদ্বেগ, মানসিক দুশ্চিন্তা—এসবও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিটি রোগীর সঙ্গে যতটা পারি কথা বলি, মনোযোগ দিয়ে শুনি। আমি বিশ্বাস করি, ভালো ব্যবহারই রোগীর অর্ধেক রোগ সারিয়ে দেয়। চিকিৎসা মানে শুধু ওষুধ দেওয়া নয়—চিকিৎসা মানে মানবিকতা। হাসপাতালের দরজা সব মানুষের জন্য খোলা। আমি চাই সবাই নির্ভয়ে আমার কাছে আসুক, কথা বলুক, প্রশ্ন করুক। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা লিখে রোগীর উপর বোঝা চাপানোর কোনো মানবিকতা নেই। চিকিৎসা হতে হবে বাস্তব, দরদি, সৎ। আমি বাহুবলের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি—এটাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। যতদিন বেঁচে থাকব, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মানবসেবায় নিয়োজিত থাকতে চাই। চিকিৎসা আমার চাকরি নয়—এটাই আমার ইবাদত, এটাই আমার জীবন।”
সমাজে এমন মানুষই বিরল, যারা নিজের পরিচয়ের সীমা ছাড়িয়ে হয়ে ওঠেন আলোর দিশা। ডা. মিজানুর রহমান শাহীনের অবদান মানুষের হৃদয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে—একজন প্রকৃত মানবিক চিকিৎসকের জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে।
দ.ক.সিআর.২৫