আসাদ ঠাকুর
অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও থামছে না লিজ বহির্ভূত নদী বা ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করলেও প্রভাবশালীদের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সঙ্গে কোনোভাবেই পেরে উঠছে না। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ।
তারা বলেন, কেবল জেলা ও উপজেলা প্রশাসন নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব পর্যায়ের দায়িত্বরতরা এবং স্থানীয়ভাবে সচেতন মহল রুখে না দাঁড়ালে এ সিন্ডিকেট মোকাবিলা করা যাবে না। কেননা অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের এ ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন দেন-দরবারের মাধ্যমে।
জানা গেছে, বালু উত্তোলনকারীরা বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে রাজনৈতিক মহল বিশেষের সঙ্গে চুক্তি করে বালু উত্তোলন করে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোয়াই নদী ও সুতাং ছড়া থেকে অবাধে বালু উত্তোলন ও ইটভাটার জন্য ফসলি জমির মাটি কাটায় পরিবেশ ও খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে পারে উপজেলাবাসী।
স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, সামান্য খরচে মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে তা অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। এমন লাভের কারণে বালু দস্যুরা বিশেষ কৌশলে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে।
এছাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার, এসি ল্যান্ড, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ টাকা জরিমানা, বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডসহ ড্রেজার ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আটক করলেও থামানো যাচ্ছে না তাদের। কেননা যারা আটক হচ্ছে তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে কিংবা তাদের পরিবর্তে অপর লোকজন ভাড়া করে প্রভাবশালী মহল পূর্বের মতো কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনও বন্ধ করা যাচ্ছে না।
গত মঙ্গলবার ০৯ ডিসেম্বর বিকাল ৩.০০ ঘটিকায় গাজীপুর ইউনিয়নের ইছালিয়া ছড়ার ইজারা বহির্ভূত স্থান হতে বালু উত্তোলনের অপরাধে অত্র ইউনিয়নের গোবরখলা গ্রামের মৃত কুটি মিয়ার পুত্র মনিরুল ইসলাম কে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী ৬০,০০০ (ষাট হাজার টাকা) অর্থদণ্ড প্রদান করেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই আগের উদ্যোমে পুনরায় বালু উত্তোলন কাজে নেমে পড়ে।
তারা বলেন, চুনারুঘাটের বিভিন্ন প্রান্তে খোয়াই, সুতাং সহ চা বাগানের বিভিন্ন ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল এসবের সাথে জড়িত বলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন রয়েছে বলে বহু অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় এর সত্যতাও রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ি, রাস্তা, ব্রিজসহ যেকোনো ধরনের কংক্রিট নির্মাণসংক্রান্ত অবকাঠামো সম্পূর্ণ বৈধ বালু দিয়ে করা হয়েছে বলে কেউ দাবি করতে পারবে না।
তারা বলেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলে নেতিবাচক পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানি ও বায়ুদূষণ, প্রাকৃতিক ভূচিত্র নষ্ট হওয়া ইত্যাদি। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, এসব নেতিবাচক প্রভাবের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনে সৃষ্ট বায়ুদূষণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের মধ্যে পরিবর্তন ঘটার ফলে তাদের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি তাদের খাদ্যের উৎসও ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মৎস্য প্রজনন-প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি চাষাবাদের জমিও নষ্ট হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, বালু উত্তোলনে পানিদূষণসহ নদীগর্ভের গঠনপ্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে এবং নদী ভাঙছে। পুরো হাইড্রোলজিক্যাল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনের কাছাকাছি মাটির ক্ষয় যেমন ঘটছে, তেমনি মাটির গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছে।
আসাদ ঠাকুর: কবি, লেখক ও সাংবাদিক
দ.ক.সিআর.২৪