➖
আসাদ ঠাকুর, অমনিবাস
শিকড়ের টানেই এত বছর ধরে চলছে ইসরায়েল–ফিলিস্তিনি সংঘাত। আর এই লড়াই তো ১০০ বছরের এক আখ্যান। সেই আখ্যানের পেছনেও রয়েছে আরেক কাহিনি। কী সেই কাহিনি? বিস্তারিত জানতে আপনাকে কিছু সময় ব্যয় করতে হবে।
একটি চুক্তি ও সংঘাতের সূচনা
ইহুহি কারা? এরাই কি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দা? সেই আলোচনা তর্কসাপেক্ষ। এই ভূখণ্ড নিয়ে এতদিনের সংঘাতের শুরুটা আসলে কোথায়?
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় আগের কথা। সালটা ১৯১৭। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি। এরই মধ্যে খবর পাওয়া গেল ব্রিটেনের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথচাইল্ডকে নাকি একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিটি মাত্র ৬৭ শব্দের। সেই চিঠি পরের ১০০ বছর অস্থির করে রাখে মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বকে। যার কারণে আজও গাজায় কান্নারত শিশুর ওপরও পড়ছে বোমা। এটাই সেই বিখ্যাত বেলফোর ঘোষণা।
কী ছিল সেই চিঠিতে, পরে যা হলো
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ফিলিস্তিনের ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে ব্রিটিশ সরকার। অথচ ফিলিস্তিনের ৯০ শতাংশ ভূমিপুত্রই ছিল আরব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিজেদের পক্ষ জয়ের পর জাতিপুঞ্জের (বর্তমান জাতিসংঘের পূর্বসুরী) দেওয়া ক্ষমতাবলে ১৯২৩ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত ফিলিস্তিন এলাকা শাসন করে ব্রিটেন। এটি ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেট’ নামে পরিচিত। এ সময়ে ইহুদিরা দলে দলে ফিলিস্তিনে আসার সুযোগ পায়। এ ছাড়া অনেকে নাৎসিবাদের অত্যাচার থেকে পালিয়ে আসেন।
নিজ ভূমিতে ইহুদিদের সংখ্যা বাড়তে দেখে শঙ্কায় পড়ে যায় ফিলিস্তিনিরা। এ ছাড়া শাসক ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনিদের জমি-জমা, ঘরবাড়ি জব্দ করে সেগুলো ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের দিতে থাকে।ফিলিস্তিনে ক্রমেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পরিণামে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এর নাম ‘আরব বিদ্রোহ’, যা ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ১৯৩৬ সালে নবগঠিত আরব জাতীয় কমিটি ফিলিস্তিনে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকবাদ এবং ইহুদি অভিবাসনের প্রতিবাদে ইহুদি পণ্য বর্জন এবং কর দেওয়া বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়। অনেকটা ভারতীয় উপমহাদেশের স্বদেশী আন্দোলনের মতো।
ধর্মঘট চলে প্রায় ছয় মাস। ভারতীয় উপমহাদেশের মতো সেখানেও এই বিদ্রোহ দমনে কৌশল ও বর্বরতার আশ্রয় নেয় ব্রিটিশরা। অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ইসরায়েল যা করছে, সেই বীজ রোপণ করেছিল ব্রিটিশরাই।
দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ শুরু হয় ১৯৩৭ সালে। ভারতীয় উপমহাদেশের মতোই এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় ফিলিস্তিনি কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন।
এবার আরও বর্বরতা নিয়ে নামে ব্রিটেন। ১৯৩৯ সালের দিকে ফিলিস্তিনে ৩০ হাজার সেনা জড়ো করে। বিভিন্ন গ্রামে আকাশ থেকে নির্বিচারে বোমা ফেলা হয়। জারি করা হয় সান্ধ্য আইন। ফের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়। প্রতিবাদকারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিচারের নামে প্রাণদণ্ড দেওয়া এবং তা কার্যকর করা হতে থাকে।
বহিরাগত ইহুদিদের নিয়ে গঠন করা হয় বিশেষ বাহিনী। সন্ত্রাসবিরোধী নাম করে সশস্ত্র গোষ্ঠী গঠন করা হয়, নাম দেওয়া হয় স্পেশাল নাইট স্কোয়াড। বসতি স্থাপনকারীরা গোপনে ‘ইসউভ’ নামের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগেই অবশ্য তারা অস্ত্র পাচার করে আনতে শুরু করে। অস্ত্র তৈরির কারখানাও তৈরি হয়। ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হাগানাহ’ গঠিত হয়, যা পরে ইহুদি সেনাবাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
আরব বিদ্রোহে অন্তত ৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত, ১৫–২০ হাজার আহত এবং ৫ হাজার ৬০০ কারারুদ্ধ হয়।
জাতিসংঘের পরিকল্পনা ও কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা
এভাবে নির্যাতন আর বর্বরতায় ফিলিস্তিনিদের অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে দিতে শুরু করে। আর ইহুদিদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক ইহুদি দলে দলে এই ভূখণ্ডে আসতে শুরু করে। স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে থাকা শুরু হয়। অবস্থা এমন হয় যে, ১৯৪৭ সালের দিকে এসে দেখা যায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা বেলুনের মতো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তারা তখন মোট জনসংখ্যার এক–তৃতীয়াংশ। অথচ ওই সময় তারা দেশটির মাত্র ৬ শতাংশ ভূখণ্ডের মালিক ছিল। এর পর যা ঘটে, তা ফিলিস্তিনিদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটাই বলা যায়।
জাতিসংঘ ১৮১ ইশতেহার গ্রহণ করে এবং ফিলিস্তিনকে আরব এবং ইহুদি অংশে ভাগ করার আহ্বান জানায়। এ প্রস্তাবে ফিলিস্তিনের উপকূলীয় এলাকায় সবচেয়ে উর্বর জমিসহ ৫৬ শতাংশ জায়গা ইহুদি রাষ্ট্রকে দেওয়ার কথা বলা হয়। নিজেদের জায়গা এভাবে চলে যাওয়া কি মেনে নেওয়া যায়? এত দিন কি এ জন্য নির্যাতন সহ্য করেছে? এ কারণে ফিলিস্তিনিরা এ ইশতেহার প্রত্যাখ্যান করে। ওই সময় ওই এলাকার ৯৪ শতাংশ ছিল ফিলিস্তিনিদের অধিকারে এবং জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশে ছিল এই ভূমিসন্তানরা।
ফিলিস্তিনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হাত থেকে চলে যাওয়ার আগে শেষ ভয়াবহতা দেখায় ব্রিটিশরা। তবে এবার তাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয় ইহুদি গোষ্ঠীগুলো। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশদের হাত থেকে শাসনভার চলে যায়। এর আগে বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ইহুদিরা।
১৯৪৮ সালের এপ্রিলে জেরুজালেমের উপকণ্ঠে দেইর ইয়াসিন গ্রামে শতাধিক নিরীহ ফিলিস্তিনিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর মধ্য দিয়েই মূলত বিশেষ এসব অভিযানের ধরন ঠিক করে ফেলা হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিন শহর, বাজার, গ্রাম ও নগর ধ্বংস করা হয়। এই ধ্বংস তৎপরতাকে ফিলিস্তিনিরা উল্লেখ করে ‘নাকবা’ হিসেবে। আরবিতে নাকবার অর্থ ‘মহাবিপর্যয়’। লাখো মানুষ ঘরছাড়া হয়।
এভাবে নিজেদের জন্য জায়গা দখল করে নেয় ইহুদিরা। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৭৮ শতাংশের দখল তাদের কাছে চলে যায়। বাকি ২২ শতাংশই হলো আজকের অধিকৃত পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। অন্তত সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে জোর-জবরদস্তি করে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়।
সেই নাকবার কাহিনি এখনকার ফিলিস্তিনবাসী না দেখলেও, ভয়াবহতার গল্প শুনেছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলেছে সেই দুর্যোগের কাহিনি। এ কারণে গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার মধ্যে সেই নাকবার কথাই সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছে তাদের। নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত প্রায় ৬০ লাখ ফিলিস্তিনি এখন লেবানন, সিরিয়া, জর্দান ও মিসরের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় শুরু যুদ্ধের ভয়াবহতা
১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। পরদিনই প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। মিসর, লেবানন, জর্দান ও সিরিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এ লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে ‘১৯৪ ইশতেহার’ পাস করা হয়। এই ইশতেহারে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকারের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু তা আর কার্যকর হয় না। এই ইশতেহার কখনোই বাস্তবে রূপ পায়নি।
অন্তত দেড় লাখ ফিলিস্তিনি নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েলি রাষ্ট্রে থেকে যায়। তাদের প্রায় ২০ বছর কঠোর সামরিক দখলদারির মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়। পরে ধীরে ধীরে ইসরায়েলের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। নিজেদের মাটিতেই নাগরিকত্ব নিতে ফিলিস্তিনিদের অপেক্ষা করতে হয়েছে এক যুগের বেশি সময়।
মিশর গাজা উপত্যকা দখলে নেয়। ১৯৫০ সালে পশ্চিম তীরের ওপর প্রশাসনিক তৎপরতা শুরু করে জর্দান। ১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা বা পিএলও গঠন করা হয়। এক বছর পরে রাজনৈতিক দল ফাতাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদ আসতে থাকে একের পর এক।
ছয়দিনের যুদ্ধ ও আরবের হার
১৯৬৭ সালের ৫ জুন ৬ দিনের যুদ্ধে আরবদের সঙ্গে জিতে যাওয়ার পর ফিলিস্তিনের বাকি অংশও দখল করে নেয় ইসরায়েল। আরব জোটের সেনাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ যুদ্ধে গাজা উপত্যকা, মিশরের সিনাই উপদ্বীপ, সিরিয়ার গোলান উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম– সবই দখল করে নেয় ইসরায়েল। এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দফা ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করা হয়। একে বলা হয় ‘নাকসা’। আরবি এই শব্দটির অর্থ ‘বিপত্তি’।
১৯৬৭–র ডিসেম্বরে মার্ক্সবাদী-লেলিনবাদী পুপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব ফিলিস্তিন গঠন করা হয়। পরবর্তী এক দশক ধরে পরিচালিত ধারাবাহিক হামলা ও বিমান ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে বাম গোষ্ঠীটি ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় এর মধ্যেই ইহুদি বসতি স্থাপনের তৎপরতা শুরু হয়। সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় বসতি স্থাপনকারীদের। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাদের কোনো নাগরিক বা রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়নি। কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে তাদের জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়।
প্রথম গণজাগরণ (১৯৮৭-১৯৯৩)
ফিলিস্তিনি প্রথম ‘ইন্তিফাদা’ বা গণজাগরণের সূচনা হয় গাজা উপত্যকায়। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনি শ্রমিকবাহী দুটো ভ্যানের সঙ্গে ইসরায়েলি ট্রাকের সংঘর্ষে চার ফিলিস্তিনির নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই গণজাগরণের সূচনা।
গণজাগরণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম তীরে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ট্যাংকবহর ফিলিস্তিন তরুণদের ছোঁড়া ইট-পাটকেলের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। দখলদার ইসরায়েলিদের প্রতিরোধের মুখেই গঠিত হয় হামাস আন্দোলন। সেই হামাসই গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে দিকে ৫ হাজারের বেশি রকেট ছুড়ে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে।
কঠোর হাতে গণজাগরণ দমন করতে নামে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজহাক রবিন ঘোষণা দেন, ‘ফিলিস্তিনিদের হাড় গুড়িয়ে দেওয়া হবে’। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফিলিস্তিনি তরুণেরা, রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে গঠিত ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিডারশিপ অব দ্য আপরাইজিং। লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
এর মধ্যেই ১৯৮৮ সালে পিএলওকে ফিলিস্তিনি মানুষের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় আরব লিগ।ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বি’টসেলিমের দেওয়া তথ্যমতে, প্রথম গণজাগরণের সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে ২৩৭ শিশুসহ ১ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। গ্রেপ্তার হয় এক লাখ ৭৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।
অসলো চুক্তি ও শক্ত দেয়াল
অসলো চুক্তি সই করার মধ্য দিয়ে ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) প্রতিষ্ঠা পায়। এরপরই প্রথম গণজাগরণের সমাপ্তি ঘটে। অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা শাসনের অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে তৈরি করা হয় পিএ। এর আওতায় সীমিত স্বশাসনও মঞ্জুর করা হয়।
দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আওতায় ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় পিএলও। পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এবং ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ জায়গা ও পানিসম্পদ ইসরায়েলকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হয়। কথা ছিল পিএ প্রথম ফিলিস্তিনি সরকার নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে এবং পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকাকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এ সরকারের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। তবে এমনটি আজও হয়নি।
গাজা উপত্যকা ঘিরে ১৯৯৫ সালে ইলেক্ট্রনিক ও কংক্রিটের দেয়াল তোলে ইসরায়েল। এতে বিভক্ত দুই ফিলিস্তিনি অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সীমিত হতে থাকে ফিলিস্তিনিদের চলাচল।
দ্বিতীয় গণজাগরণ
দ্বিতীয় গণজাগরণ শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে। ইসরায়েলের রাজনৈতিক দল লিক্যুদ পার্টির নেতা অ্যারিয়েল শ্যারন পবিত্র আল–আকসা চত্বর পরিদর্শন করেন। একে কেন্দ্র করে জেরুজালেমের পুরোনো নগরীর ভেতরে ও বাইরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়।
এতে বিক্ষোভ শুরু হলে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে সংঘাতে দুই দিনে ৫ ফিলিস্তিনি নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হয়। এই ঘটনায় ব্যাপক সশস্ত্র অভিযান চালায় ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোর নজিরহীন ক্ষতি করে তারা।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ শাসিত অঞ্চলগুলো আবার দখল করে নেয় ইসরায়েল। সেখানে প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করে। সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের এ জন্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়, দিতে হয় চরম মূল্য। দখল করা অঞ্চলে বসতি নির্মাণকে আন্তর্জাতিক আইনে পরিষ্কারভাবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। ইহুদিদের জন্য বসতি স্থাপন করার তোড়ে ফিলিস্তিনি অঞ্চল ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। দখল করা ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের মধ্য দিয়ে কেবল বসতি স্থাপনকারীদের জন্য রাস্তা ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। এতে ফিলিস্তিনের নগর ও শহরগুলো ছিটমহলের মতো হয়ে যায়।
অসলো চুক্তি সইয়ের সময় পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে এক লাখ ১০ হাজারের বেশি ইহুদি বসতি স্থাপনকারী বাস করত। কিন্তু এখন এ সংখ্যা বেড়ে সাত লাখে দাঁড়িয়েছে। এক লাখ হেক্টর বা ৩৯০ বর্গমাইল জায়গা ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের বিভক্তি ও গাজা অবরোধ
পিওলওর নেতা ইয়াসির আরাফাত ২০০৪ সালে মারা যাওয়ার পর এক বছর যেতে না যেতেই দ্বিতীয় গণজাগরণের অবসান ঘটে। এরই মধ্যে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি বসতি সরিয়ে নেওয়া হয়। ৯ হাজার ইসরায়েলি সেনাসহ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে আসে।
এক বছর পর ফিলিস্তিনিরা প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ভোট দেয়। হামাস বেশির ভাগ আসনে জয়ী হয়। এরপর ফাতাহ-হামাস গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কয়েক মাসের সেই গৃহযুদ্ধে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়। গাজা উপত্যকা থেকে ফাতাহকে বের করে দেয় হামাস এবং পিএর প্রধান দল ফাতাহ পশ্চিম তীরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
২০০৭ সালে হামাসের বিরুদ্ধে কথিত সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে গাজা উপত্যকার ওপর অবরোধ চাপিয়ে দেয় ইসরায়েল।
গাজা উপত্যকার ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে চারবার সামরিক হামলা চালায় ইসরায়েল। নির্বিচার হামলায় নারী শিশুসহ অনেক নিহত হয়। হাজারো ঘরবাড়ি, স্কুল ও সরকারি ভবন গুড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে ফসফরাস বোমার মতো আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্রও ব্যবহার করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ)।
২০১৪ সালে ৫০ দিনে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৫০০ শিশু, ১ হাজার ৪৬২ বেসামরিক মানুষসহ ২ হাজার ১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ‘অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ’ নামে পরিচিত ইসরায়েলের এ আগ্রাসনে অন্তত ১১ হাজার ফিলিস্তিনি আহত হয়। ধ্বংস করা হয় ২০ হাজার ঘরবাড়ি। বাস্তুহারা হয় অন্তত ৫ লাখ মানুষ।
গাজায় প্রতি ৩০ সেকেন্ডে পড়ছে একটি করে বোমা।
হামাসের রকেট হামলা ও নতুন বিপর্যয়
একদিকে ইসরায়েল গাজা অরবোধ করে রেখেছে। অন্যদিকে পশ্চিম তীরে প্রায় প্রতিদিনই ফিলিস্তিনি নিহতের খরব আসতে থাকে। এসবের মধ্যেই গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায় হামাস। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলের বিভিন্ন জায়গায় এসে আঘাত হানে প্রায় ৫ হাজার রকেট।
এরপর নতুন করে আবার শুরু হয় সংঘাত। গাজায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। স্থল হামলার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এমনকি পশ্চিম তীরেও মারা যাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। এ পর্যন্ত ৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। হামাসের হামলায় মারা গেছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ ইসরায়েলি।
গাজায় ১৩ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও সেখানে করা হচ্ছে হামলা। এক হাসপাতালে হামলায় ৪ শতাধিক মানুষ মারা যায়। এমনকি আশ্রয়কেন্দ্রেও এসে পড়ছে বোমা।
গাজাবাসীকে অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। জাতিসংঘ বলছে, প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাসের শহর গাজা থেকে নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। অর্থাৎ অবরুদ্ধ এই উপত্যকার প্রায় অর্ধেক মানুষই বর্তমানে বাস্তুচ্যুত।
অনেকেই বলছেন, এটি দ্বিতীয় ‘নাকবা’। এটা প্রথম বিপর্যয়ের চেয়ে আরও ভয়াবহ হবে। ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করছে আরব দেশগুলো। তবে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো সরাসরি সহায়তা করছে ইসরায়েলের। এই সংঘাত কত দীর্ঘ হবে, তা বলা মুশকিল। তবে যত দীর্ঘই হোক, ফিলিস্তিনিদের কষ্টের দিন বাড়ছেই।
আসাদ ঠাকুর
কবি, লেখক ও সাংবাদিক
দ.ক,সিআর.২৫