সায়্যেদ হুসাইন চৌধুরীঃ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরোদস্তুর স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখেন। এসময় তিনি সংবিধান সংশোধন করে ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার বৈধ পথ তৈরি করেন। ফলে পরপর ৩টি নির্বাচনে ব্যাপকহারে ভোট জালিয়াতির সপ্রমাণ অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কার্যত কোন প্রতিপক্ষ ছাড়াই সংসদ নিজের দখলে রাখেন তিনি। ফ্যাসিবাদের আদলে উন্নয়নের চাকচিক্যময়তার আড়ালে তিনি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে নিজের ক্ষমতা রক্ষায় ব্যবহার করেন। বিচার বিভাগ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আমলা থেকে শিক্ষক সবকিছুকে তিনি তার রেজিমবান্ধব করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তিনি নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করেন, ভিন্নমতকে পুরোপুরি দমন করেন, আইন করে সমালোচনার পথ বন্ধ করেন, খুন-গুমের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি জাগিয়ে তোলেন। এভাবেই চলছিলো তার দুর্দান্ত শাসন, গণতন্ত্রের মোড়কে ফ্যাসিবাদের অনুষ্ঠানমুখর চর্চা।
সরকার সর্বোত চেষ্টা করেছেন নিজের একক ইচ্ছাকে রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নির্মাণের নিরংকুশ নীতি হিসেবে বেছে নিতে, তবুও এই সময়ে কয়েকবার চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। এসবের মধ্যে হেফাজত, ছাত্র অধিকার পরিষদ ইত্যাদি সহ কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাক্তিবিশেষও ছিলেন এবং মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীও তাদের একজন ছিলেন। শিক্ষাব্যবস্থার দুর্দশা নিয়ে তিনি সবসময় সরব ছিলেন। সভা-সেমিনারের মাধ্যমে তিনি এ ব্যাপারে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। এমনকি এই সময়ে স্বৈরাচারের সামনে অনুচ্চারণীয় অনেক সত্যও তিনি দুর্দান্ত সাহসিকতার সাথে উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন- “ফাইজলামি করার আর জায়গা পান না। দেশদ্রোহী বলে মানুষকে শায়েস্তা করতেছেন। সবচেয়ে বড় দেশদ্রোহী তারা, যারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ডকে অন্যের হাতে বিকিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় গাদ্দারী হচ্ছে এই ব্যবস্থাপনা যে, অন্য দেশের প্ররোচনায় আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো হচ্ছে।”
এরপর সরকারপ্রধান শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে আলেমদের মতামত কী সেটা জানতে সম্মত হন। মাওলানার নেতৃত্বে দারুন্নাজাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মহোদয় সহ একদল আলেম সরকারের সাথে মিটিং করেন। আলেমদেরকে তাদের দাবী মানার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে পাঠ্যবইয়ে বেশ কিছু পরিবর্তনও আনা হয়। ফ্যাসিবাদ যেহেতু আত্মীকরণের নীতি অনুসরণ করে, এরই ধারাবাহিকতায় মাওলানাকে চাপ দেয়া হয় যেন তিনি সংসদে এসব কথা বলেন। সঙ্গত কারণেই এটা অস্বীকার মানে হচ্ছে পরবর্তীতে কোন দাবী নিয়ে সামনে যাওয়ার পথকে সংকীর্ণ করে তোলা। ফ্যাসিবাদের চাপ কয়েক যুগের দক্ষ রাজনীতিবিদদের যেমন অক্ষম ও অকার্যকর করে দিয়েছিলো, মাওলানার ক্ষেত্রেও এই চাপ সমান শক্তির ছিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে নির্বাচনে দাঁড়াতে হলো, মন্দের ভালো হিসেবে তিনি নৌকা প্রতীক এড়িয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীতা বেছে নেন।
সাংসদ নির্বাচিত হয়ে অল্পদিনে তিনি সংসদে পাঠ্যবইয়ের অসঙ্গতি উল্লেখ, ইসরাইলের ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভুল অভিমুখগ্রহণের ইঙ্গিত জ্ঞাপন ইত্যাদি প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। নিজের নির্বাচনী এলাকায় রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার ও হয়রানি যাতে না হয়, সেজন্যও তিনি সরব ছিলেন। গত মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে সরকারের আত্মম্ভরিতা যখন ছাত্র-জনতার রক্তের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিলো, তখন তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাধীন ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীজে ইসলামিয়া’র মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, ছাত্রদের উপর হামলার নিন্দা জ্ঞাপন ও এমন বর্বরোচিত হামলাকে স্পষ্টভাবে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং বিভিন্ন মাহফিল-অনুষ্ঠানে তিনি জনমতকে জুলুমের বিপক্ষে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্ত তাঁর পরিবার ও সিলসিলার ঐতিহ্য ও অঘোষিত অঙ্গীকার মানুষের মনে যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিলো, সে অনুপাতে তিনি কোন ভূমিকা রাখতে পারেননি। তদুপরি এই সংকটে ফ্যাসিস্ট তাঁকে ব্যাবহার করেছে, তাঁর কৌশলী বক্তব্যকে নিজের অনুকূলে পরিবর্তন করে প্রচার করেছে। মাওলানার কৌশলী অবস্থান নয়; বরাবরের মত তাঁর স্পষ্ট জনহিতৈষণা দেখতে পারার যে প্রত্যাশা ছিলো, এখানেই অপ্রাপ্তির ব্যথা তৈরি হয়েছে জনমনে। মিশরে ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেমদেরকে কাছে টানতে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের যে প্রচেষ্টা এডওয়ার্ড সাইদ Orientalism এ দেখিয়েছেন, মাওলানা হুছমুদ্দীন চৌধুরীর ক্ষেত্রেও অনুরূপ ধূর্ততার আশ্রয় নিয়েছে ফ্যাসিস্ট রেজিম।
How fascism works (ফ্যাসিজম কিভাবে ফাংশন করে) এর উত্তরে স্টেইনলি জ্যাসন যা বলেছেন, এর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে ‘আমরা ও তারা’ বলে বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে ফ্যাসিজম কাজ করে। কারো উপর ক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু কারো ব্যাক্তিগত রাজনৈতিক দর্শন যদি অন্যকে আহত না করে, সেক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে অহেতুক বিদ্বেষ পোষণ বা অপবাদ আরোপ করে কোনঠাসা করার চিন্তা লালন- ফ্যাসিবাদেরই একটি রূপ। যেখানে শাপলায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হেফাজত নেতা আল্লামা আহমদ শফি (রাহি.) শেখ হাসিনার হাতে হাত রেখেছেন (কিংবা অন্তত ফ্যাসিস্ট পরিকল্পিতভাবে এরকম একটি দৃশ্যপট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে), শাপলার মজলুমরা যেখানে স্বৈরাচারের পাশে বসেছেন উল্লসিত হয়ে, যেখানে কওমি উলামার কাছ থেকে রক্তখেকো স্বৈরাচারের উপাধির ঝুলি সমৃদ্ধ হয়েছে ‘কওমি জননী’ লকব পেয়ে, যেখানে মির্জা ফখরুল স্বাধীনতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভাসানী, বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের গুণকীর্তন করেন কিন্তু তার দলের আদর্শিক ভিত্তিপ্রাণ মেজর জিয়ার নামোচ্চারণ পর্যন্ত করেন না, যেখানে শিবিরকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজেকে আন্তঃপ্রাণ ছাত্রলীগকর্মী প্রমাণ করতে গিয়ে অন্যের ফেইসবুক ওয়ালে হাদীস প্রচার দেখে সন্ত্রস্তচিত্ত হয়ে সতর্কতার পরামর্শ দেন এবং হলের সিট ধরে রাখতে ক্লাস বাদ দিয়ে হাততালি মুখর জয়ধ্বনি উচ্চারণ করে ফ্যাসিবাদের জুলুম এড়ানোর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত সময় পার করেন, সেখানে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর এই কৌশলী অবস্থানকে দালালী বলা যে ইনসাফ নয়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখিত ঘটনাগুলোর মত বিষয় সংঘটি করার জন্য ফ্যাসিজম যে কৌশলের আশ্রয় নেয়, এটি হচ্ছে ফ্যাসিনেইশন। জার্মান তাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ফ্যাসিজমের ফাংশনিং স্টাইলের বর্ণনা দিয়েছেন- “In great ceremonial performances, the mass has to be handled in a way that puts them under the leader’s spell and enables him to use them for his own ends.”
ফ্যাসিবাদ যুগপৎভাবে বলপ্রয়োগ, ভীতি উৎপাদন ও চোখ ধাঁধানোর কাজ করে। তাই ফ্যাসিবাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনটা সঠিক কোনটা সঠিক নয় এটা বোঝা গেলেও, যেটি সঠিক নয় সেটির বিরোধিতা করার সঠিক সময় ও উপযুক্ত পদ্ধতি নির্ধারণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। এখানে অনেকের ক্ষেত্রে এটা হয়েছে; মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত সঠিক না ভুল- সেটা ঠিক ভাবে ধরতে পারা তাঁর পক্ষে কঠিন ছিলো। তিনি তাঁর পূর্বের সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করেছেন, ডান বাম না পেচিয়ে সরাসরিই বলেছেন- “এই নির্বাচনে যাওয়া আমার ঠিক হয়নি।” অবশ্য নির্বাচনকালীন একটি অনুষ্ঠানেও তিনি বলেছিলেন- “আমি নিজের ইচ্ছায় নির্বাচনে আসিনি। নিজেকে কোরবান করে আমি এখানে এসেছি।”
মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী গণমানুষের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন, আগেও বলেছেন। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, দুর্যোগ কবলিত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে বিপর্যস্তের দ্বারস্থ হয়ে নিজ উদ্যোগে সহায়তা করা কিংবা বিচারবঞ্চিত মানুষকে সুবিচার পাইয়ে দেয়ার জন্য নিজেকে যতটুকু প্রয়োজন জড়িত করা– এগুলো তাঁর সূফিধারার কার্যক্রম ও পারিবারিক ঐতিহ্যের অপরিহার্য অংশ। তিনি তাঁর এসব সেবাধর্মী কাজের মাধ্যমে সর্বদা এই দেশে, জনগণের মানসপটে প্রাসঙ্গিক থাকবেন। কারো অপপ্রচার কিংবা বিদ্বেষতাড়িত অপরায়নের চর্চা, তাঁকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলতে পারবে না। কেউ চাইলেই কাউকে সম্মানিত কিংবা অসম্মানিত করতে পারে না, এটা করতে পারেন আল্লাহ। আমরা দেখেছি, দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ফ্যাসিবাদী শাসন ভিন্নমতের রাজনীতিকে নিস্ক্রিয় এবং নির্মূল করতে চাইলেও একটি অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আল্লাহ তাদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ এনে দিয়েছেন। ফলে আজ তারা নিজেদেরকে ক্ষমতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন বলে কল্পনা করতে পারছেন, অথচ মাসখানেক আগেও এটা ছিলো সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ও কল্পনাতীত।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সদ্য অতীত রাজনীতি থেকে কেবল ক্ষোভ সঞ্চার, বঞ্চনার স্মৃতিচারণ, প্রতিহিংসার নির্মোঘ প্রতিফলন আর প্রতিশোধ লালন করাই নয়, বরং অভিজ্ঞতাজাত কিছু শিক্ষা গ্রহণও জরুরি। বিরোধীপক্ষকে নির্মূলের চেষ্টা, ভিন্নমত দমন কিংবা এর বিরুদ্ধে ঘৃণা উৎপাদনের রাজনীতি যে পরিপুষ্ট একটি ক্ষমতা মূলোৎপাটনের প্রয়োজনীয়তাকে তীব্রতর করে তোলে, সেটা থেকে শিক্ষা না নেওয়া হলে আগামীর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একই ভাগ্য বরণ করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
—-
লেখক: Saeed Hussain Chowdhury
০৮.০৮.২০২৪
কে/সিআর/২৪