জাকির হোসেন: নেত্রকোনার হাওরদ্বীপ খালিয়াজুরীতে প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত শত শত কোটি টাকার দেশীয় মাছ এখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এক সময়ের মাছের প্রাচুর্যে ভরা হাওর এখন দিন দিন হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য। বিষ প্রয়োগে মাছ ধরা, জলাশয় শুকিয়ে ফেলা, নিষিদ্ধ জালের ব্যাবহার, প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে মাছ শিকার, পোনা মাছ নিধনসহ নানা কারণে হাওরের মৎস্য সম্পদ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়রা।
খালিয়াজুরী উপজেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে এ উপজেলার জলাভূমির আয়তন ২৩ হাজার ২৮০ হেক্টর থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে তা নেমে আসে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টরে। মৎস্য বিভাগের জরিপে দেখা গেছে, ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে এখানে উৎপাদিত মাছ এবং তৈরি শুটকির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৮২৩ মেট্রিক টন। পরের বছর তা নেমে আসে ১৯ হাজার ৭৪৯.৯৩ মেট্রিক টনে- অর্থাৎ উৎপাদন কমেছে প্রায় ৭৩ মেট্রিক টন। এতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার মাছের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় মৎস্য বিভাগ।
খালিয়াজুরী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র রক্ষায় ইতিমধ্যে উপজেলার মরা ধনু, নামাবাজজুয়াইল, সিন্ধুকের বাগ, বাদিয়ারচর, টানচুনাই- এই ৫টি জলাশয়কে ‘অভয়াশ্রম’ ঘোষণার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে মৎস্য অধিদপ্তরে। তিনি আরও জানান, অভয়াশ্রম ঘোষণা হলে ওই ৫টি জলাশয়ের ২৫.৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে হিজল করস গাছের ডাল ও বাশঁ দিয়ে মাছের নিরাপদ আশ্রয় স্থল গড়ে তোলা হবে। এখানে সারা বছর নিষিদ্ধ থাকবে মাছ ধরা।
বোয়াল, রুই, কাতল, চিতল, আইর, গলদা চিংড়ি, বাইম, পাবদা, গুলসা, টেংরা, পুটি- এসব দেশীয় মাছের প্রাচুর্যে খ্যাত ছিল খালিয়াজুরীর হাওর জনপদ। কিন্তু প্রতিদিন মাছের পরিমাণ আশঙ্কাজনক ভাবে কমছে।
স্থানীয়রা বলছেন, এভাবে কমতে থাকলে কয়েক দশকের মধ্যেই হাওরের প্রাকৃতিক মাছ পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে। উপজেলায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন ১০ হাজার ২৬১ জন, আর মৌসুমি জেলেসহ মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত অন্তত ১৫ হাজার মানুষ। মাছ কমে যাওয়ায় তাদের জীবিকা এখন হুমকির মুখে।
খালিয়াজুরী সদরের নয়াপাড়া গ্রামের প্রবীণ জেলে শুনিল বর্মন (৩৫) বলেন, ১০ বছর আগেও দিনে ২০-৩০ কেজি মাছ ধরতাম। অহন ৫-৭ কেজির বেশি পাই না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, অনেকে বিষ ছিটাইয়া মাছ ধরে-চায়না জাল, ভীমজাল, এতে মাছ যেমন মরতাছে তেমন ভাবে হাওরের প্রাণও শেষ হইয়া যাইতাছে।
একই গ্রামের জেলে সুধীর বর্মন (৬৫), ইন্নছ মিয়া (৪০), ইসলাম উদ্দিন (৪৫) বলেন, হাওরে আগের মতো এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। তাই মাছ ধরে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
খালিয়াজুরী বাজারের ২০ বছরের পুরনো মৎস্য আড়ৎদার মো: এরশাদ মিয়া জানান, আগে প্রতিটি আড়তে প্রতিদিন ২০-৩০ কেজি গলদা চিংড়ি আর কয়েক মণ দেশীয় মাছ আসতো। এখন চিংড়ি আসে দুই-তিন কেজি, আর মোট মাছ মণ খানেকের বেশি নয়। বিষ দিয়ে ধরা মাছ বিক্রি বন্ধ না হলে এই ধ্বংস ঠেকানো যাবে না বলেও জানান তিনি।
এলাকার মানুষ জানান, এখানকার জলাশয়ে নিষিদ্ধ উপায়ে অবাধে মাছ ধরা হলেও তেমন কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সচেতনতা বৃদ্ধিতেও নেই কোন পদক্ষেপ।
উপজেলার জলাশয়গুলো ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে- এমনটি জানিয়ে খালিয়াজুরী উপজেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক রিয়াজ উদ্দীন তালুকদার সুখন মেম্বার জানান, জলমহাল ইজারা দিয়ে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব নেয়। কিন্তু এসব জলমহালের খনন বা রক্ষণাবেক্ষণে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।
খালিয়াজুরী উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এখানে ২০ একরের ওপর ৩৮টি এবং ২০ একরের নিচে ৩৩টি ইজারাযোগ্য সরকারি জলমহাল রয়েছে। গত অর্থ বছরে এর মধ্যে ৪৭টি ইজারা দিয়ে সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাদির হোসেন শামীম বলেন, মাছ ধরায় আইন ভঙ্গের খবর পেলেই প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। তবে জলাভূমি খননের বিষয়টি প্রযুক্তিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের সমীক্ষা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। বর্তমানে খালিয়াজুরীর মাছ স্থানীয় ২৩৫০ মেট্রিক টন খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হয়। কিন্তু উৎপাদন কমতে থাকলে এর প্রভাব পড়বে শুধু বাজারে নয়, জেলেদের জীবন-জীবিকাতেও। হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে একদিন হয়ত ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবে।
দ.ক.সিআর.২৫