➖
ড. তপন দেববর্মা◾
আমার পর্যবেক্ষণটি অত্যন্ত গভীর এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। আমি অর্থবিজ্ঞান,সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অপরাধবিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় ও দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ককে নিদের্শ করে বিশেষ করে একটি পুঁজিবাদী সমাজের পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত।
আসুন, আমার বক্তব্যের দুটি দিক ভেঙে আলোচনা করি, কারণ দুটির মধ্যেই সত্যতা রয়েছে।
১. (এক)
পুলিশকে পুঁজিপতিদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি
এটি মূলত সমালোচনামূলক তত্ত্ব (Critical Theory), বিশেষ করে মার্ক্সবাদী বা সংঘাত তত্ত্বের (Conflict Theory) একটি মূল যুক্তি। এই দৃষ্টিভঙ্গি গুলো তুলে ধরছিঃ
ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করাঃ
পুঁজিবাদের ভিত্তি হলো উৎপাদনের উপকরণের (কারখানা, জমি, পুঁজি) ব্যক্তিগত মালিকানা। পুলিশের একটি প্রধান কাজ হলো চুরি, ভাঙচুর এবং অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করা। এটি তুলনামূলকভাবে ধনী শ্রেণিকে বেশি সুবিধা দেয়, কারণ তাদেরই সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি রয়েছে।
শ্রমিক শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণঃ
ঐতিহাসিকভাবে, পুলিশ বাহিনীকে শ্রমিক আন্দোলন দমন করতে, ধর্মঘট ভাঙতে এবং ইউনিয়ন সংগঠকদের ভয় দেখাতে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা শ্রমিকদের দাবির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী মালিকদের (পুঁজিপতিদের) স্বার্থ রক্ষা করে, যাতে শ্রম সস্তা এবং অনুগত থাকে।
"উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা" নিয়ন্ত্রণঃ
পুঁজিবাদ অনিবার্যভাবে অসমতা, বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য তৈরি করে। এই অবস্থা থেকে উদ্ভূত সামাজিক সমস্যাগুলো, যেমন—গৃহহীনতা, ছোটখাটো অপরাধ এবং সামাজিক অস্থিরতা—মোকাবেলার দায়িত্ব প্রায়শই পুলিশের উপর পড়ে। মূল কারণ (অসমতা) সমাধান না করে, পুলিশিং ব্যবস্থার লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করার উপর মনোযোগ দেয়। এর ফলে বিদ্যমান সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় থাকে যা অভিজাতদের উপকার করে।
আইন নিরপেক্ষ নয়ঃ
এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, আইন মূলত ক্ষমতাশালীরাই তৈরি করে এবং তাদের স্বার্থেই করে। "অপরাধ" হিসেবে যা সংজ্ঞায়িত করা হয়, তা প্রায়শই দরিদ্রদের কার্যকলাপকে লক্ষ্য করে (যেমন—ভবঘুরেবৃত্তি, উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি, ছোটখাটো চুরি)। অন্যদিকে, ধনীদের ক্ষতিকারক কাজগুলো (যেমন—পরিবেশ দূষণ, আর্থিক জালিয়াতি, শ্রমিক শোষণ) প্রায়শই দেওয়ানি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয় বা সেগুলোর বিরুদ্ধে ততটা কঠোরভাবে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, পুলিশ নিরপেক্ষ শান্তি রক্ষক নয়; তারা রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী, যার প্রধান ভূমিকা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা।
২(দুই)
পুলিশকে শান্তি এবং সামগ্রিক এজেন্ডার রক্ষক হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি
এটি পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে আরও প্রচলিত বা কার্যকারিতাবাদী (Functionalist) দৃষ্টিভঙ্গি। পুলিশ বিভাগ এবং সরকারগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের উদ্দেশ্য হিসেবে এটিই ঘোষণা করে।
সামাজিক চুক্তি (Social Contract)ঃ
এই মতানুসারে, সকল নাগরিক (শ্রেণি নির্বিশেষে) রাষ্ট্রকে "বৈধ বলপ্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার" (monopoly on the legitimate use of force) দিতে সম্মত হয়। এর বিনিময়ে, পুলিশ সকলের জন্য নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রদান করে। তারা হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ করে, গার্হস্থ্য হিংসার প্রতিকার করে, মাতাল চালকদের ধরে এবং হারিয়ে যাওয়া শিশুদের খুঁজে বের করে। এই পরিষেবাগুলো কেবল ধনী নয়, সকলকেই উপকৃত করে।
অগ্রগতির জন্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখাঃ
যেকোনো সমাজের অগ্রগতির জন্য ("সামগ্রিক এজেন্ডা") একটি ন্যূনতম শান্তি, শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীল পরিবেশ প্রয়োজন। পুলিশ এই স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। তারা না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য চলতে পারত না, মানুষ নিজেদের বাড়িতে নিরাপদ বোধ করত না এবং সমাজের মৌলিক কাজগুলো ভেঙে পড়ত। এই অর্থে, তারা সমগ্র জাতির অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।
আইনের শাসনঃ
আদর্শগতভাবে, পুলিশ এমন আইন প্রয়োগ করে যা সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। একজন সিইও অপরাধ করলে তাকেও ঠিক একইভাবে গ্রেপ্তার করা উচিত, যেমনটা একজন বেকার ব্যক্তিকে করা হয়। এই নিরপেক্ষতাই ব্যবস্থার বৈধতার ভিত্তি।
সংশ্লেষণঃ
যেখানে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি মিলিত হয় বাস্তবতা হলো এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গির একটি জটিল এবং প্রায়শই পরস্পরবিরোধী মিশ্রণ।
পুলিশ এমন অনেক অপরিহার্য কাজ করে যা সাধারণ মানুষের উপকার করে। অপরাধের শিকার হলে বেশিরভাগ মানুষই চায় পুলিশ সাড়া দিক।
তবে, যে ব্যবস্থার মধ্যে তারা কাজ করে তা মৌলিকভাবে পুঁজিবাদী নীতির উপর ভিত্তি করে গঠিত। তারা যে আইন প্রয়োগ করে তা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে অগ্রাধিকার দেয় এবং যে সামাজিক শৃঙ্খলা তারা বজায় রাখে তা ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি শৃঙ্খলা।
সুতরাং, যদিও একজন স্বতন্ত্র পুলিশ অফিসার তার কাজকে "সকলের জন্য শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা" হিসেবে দেখতে পারেন, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুলিশিং ব্যবস্থাটি একটি পুঁজিবাদী সমাজে তার প্রকৃতির কারণেই বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে রক্ষা করতে কাজ করে।
সারসংক্ষেপঃ
আমি যেটা বলতে চাই। পুলিশের আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য হলো সকলের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং "সামগ্রিক এজেন্ডা" এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু যেহেতু এই "সামগ্রিক এজেন্ডা" একটি পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়, তাই তাদের কার্যকলাপ অনিবার্যভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। এর ফলে মনে হয় যেন তারা তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করছে। আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থার এটাই হলো মূল টানাপোড়েন।
লেখক (ড.) তপন দেববর্মা।
যুব অর্থনীতিবিদ
দ.ক.সিআর.২৫