➖
হাসান আবদুল্লাহ◾
পৃথিবীতে প্রতিটি মানবসন্তান পাপ-পুণ্যের স্বভাব নিয়েই আগমন করে। তাই নবী-রাসুল ব্যতীত প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনো পাপে জড়িয়ে পড়ে। কোনো না কোনো গুনাহ করে ফেলে। পাপ-পঙ্কিলতার এই পৃথিবীতে কেউ নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা বলে দাবি করতে পারে না। দাবি করলে তা হবে একান্তই মিথ্যা ও অযৌক্তিক। এমনকি বড় মুত্তাকি, পরহেজগার ও পুণ্যবান ব্যক্তিও এ স্বভাব থেকে মুক্ত নয়। সহজাত প্রবণতার কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তার থেকেও পাপের প্রকাশ ঘটতে পারে।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন, যদি তোমাদের মধ্যে পাপের স্বভাব না থাকত, আল্লাহ তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে তোমাদের পরিবর্তে এমন এক জাতি আনয়ন করতেন, যারা পাপ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত, আর আল্লাহও তাদের ক্ষমা করে দিতেন’ (মুসলিম : ২৭৪৯)। আরেক হাদিসে বলেন, ‘প্রতিটি আদমসন্তান গুনাহগার। আর গুনাহগারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম তারাই, যারা তওবা করে।’ (ইবনে মাজা : ৪২৫১)
স্রষ্টার ভালোবাসা অর্জন
মহান আল্লাহর মহব্বত ও ভালোবাসার চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে বান্দার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ার কথা বলেছেন এভাবে, ‘আর যারা মুমিন, আল্লাহর সঙ্গে তাদের ভালোবাসা প্রগাঢ়’ (সুরা বাকারা : ১৬৫)। তাই প্রতিটি মুমিন মুসলমানের একান্ত কামনা এই হওয়া চাই যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ভালোবাসবেন এবং আপন নৈকট্য দ্বারা ধন্য করবেন। আর এ জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা, প্রচেষ্টা ব্যয় করা এবং ভালোবাসা লাভের অন্যতম মাধ্যম তওবাকে বন্ধু বানিয়ে নেওয়া। কেননা যারা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি তওবা করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন পূর্ণাঙ্গরূপে পবিত্রতা অর্জনকারীদের।’ (সুরা বাকারা : ২২২)
পাপ যখন পরিবর্তিত হয় পুণ্যে
মহান আল্লাহর দান ও ইহসানের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। সত্যিকারের তওবা হলে পাপ মোচনের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবর্তে পুণ্যও লিখে দেওয়া হয় উদারতা ও অকৃপণতার সঙ্গে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তবে যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গুনাহগুলো নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সুরা ফুরকান : ৭০)। আবু জর গিফারি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সর্বশেষ জাহান্নাম থেকে বের হবে এবং সর্বশেষ জান্নাতে প্রবেশ করবে তার সম্পর্কে আমি জানি। কেয়ামতের দিন লোকটিকে উপস্থিত করা হবে, আর বলা হবে, বড় বড় গুনাহগুলো ক্ষমা করে ছোট ছোট গুনাহগুলো তার সামনে পেশ করো। ছোট ছোট গুনাহগুলো তার সামনে পেশ করে বলা হবে, অমুক অমুক দিন অমুক অমুক আমল করেছ, অমুক অমুক দিন অমুক অমুক কাজ করেছ। সে অস্বীকার করতে পারবে না, বলবে, হ্যাঁ, করেছি। সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় গুনাহের ব্যাপারে শঙ্কিত থাকবে, না জানি সেগুলো তার সামনে পেশ করা হয়। তখন বলা হবে বান্দা তোমার প্রতিটি পাপের বিনিময়ে একটি করে পুণ্য দেওয়া হলো। এটা দেখে সে বলবে আমার প্রতিপালক, আমি তো আরও অনেক পাপ করেছি, যা এখানে দেখছি না। বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, এই হাদিস বলে রাসুল (সা.)-কে হাসতে দেখেছি, এমনকি তার মাড়ির দাঁত পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছিল’ (মুসলিম : ১৯০)। এই যে আল্লাহ তায়ালা পাপের পরিবর্তে পুণ্যদান করবেন তা কিসের জন্য? হয়তো আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে অথবা বান্দার কৃত তওবার কারণে।
সুন্দর ও সুখময় জীবন লাভ
আখেরাতের জীবনে যেমন, তেমনি দুনিয়ার জীবনেও প্রত্যেক মুসলমান সুন্দর ও সুখময় জীবনের প্রত্যাশী। পার্থিব জীবনে এই সুন্দর ও সুখময় জীবনেরও নিশ্চয়তা রয়েছে তওবা-ইস্তেগফারের মধ্যে। কায়মনোবাক্যে যে যত তওবা-ইস্তেগফার করবে সে তত আবিলতামুক্ত সুন্দর জীবন লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি গুনাহের পঙ্কিলতায় ডুবে থাকবে এবং তওবা-ইস্তেগফার থেকেও বিমুখ থাকবে তার জীবন হবে সংকীর্ণ ও অসুন্দর। সে জীবনের সাধ খুঁজে পাবে না। হতে পারে কেউ পাপের সাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেও সম্পদ-প্রাচুর্য ও পার্থিব জৌলুস লাভ করবে। কিন্তু সুখ ও প্রশান্তির হরিণ থাকবে অধরাই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ইস্তেগফার করো এবং তওবা করো তা হলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তিনি তোমাদের সুন্দর জীবনোপকরণ দান করবেন। আর যদি তা থেকে বিমুখতা প্রদর্শন করো তা হলে আমি তোমাদের ব্যাপারে আশঙ্কা বোধ করি এক মহাদিবসের শাস্তি।’ (সুরা হুদ : ৩)
দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন
দুনিয়া দুঃখ, পেরেশানি ও দুশ্চিন্তার জায়গা। চলার পথে জীবনের বাঁকে যেকোনো সময় যেকোনো সংকট-সমস্যায় জর্জরিত হওয়া স্বাভাবিক, খুবই স্বাভাবিক। তাই একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ কোনো না কোনোভাবে ডিপ্রেশন ও দুঃখ-দুশ্চিন্তার ঘেরাটোপে বন্দি। জীবনের স্বাদকে ফিকে করে দেওয়া এসব পেরেশানি থেকে বাঁচারও অন্যতম উপায় হচ্ছে, গুনাহ ছেড়ে আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া এবং নিবিষ্টচিত্তে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকা।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইস্তেগফারকে আঁকড়ে ধরবে আল্লাহ তায়ালা তাকে সব সংকট থেকে বের হওয়ার পথ এবং সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায় বের করে দেবেন আর তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দেবেন যে, সে কল্পনাও করতে পারবে না।’ (আবু দাউদ : ১২৯৭)
সম্পদ ও সন্তানে বরকত
পার্থিব ধনসম্পদ, বাগবাগিচা ও সন্তান-সন্ততিতে বরকত লাভেরও বড় মাধ্যম বানিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা আপন প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে উন্নতি দান করবেন এবং তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান আর তোমাদের জন্য নদ-নদীর ব্যবস্থা করে দেবেন’।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তওবামুখী জীবন কাটানোর তওফিক দিন। আমীন
দ.ক.সিআর.২৪